শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বার্তা দিয়ে ইরাকে ঐতিহাসিক সফর শেষ করলেন পোপ ফ্রান্সিস।
সোমবার বাগদাদ থেকে ভ্যাটিকানের উদ্দেশে বিমানে ওঠেন পোপ। ৮৪ বছর বয়সী এই ক্যাথলিক ধর্মগুরুকে বিদায় জানান ইরাকের প্রেসিডেন্ট বারহাম সালিহ।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে এই প্রথম কোনো পোপ সফর করলেন। তিনদিনের এই সফরে যুদ্ধবিধ্বস্ত চারটি শহর পরিদর্শন করেছেন তিনি। দেখা করেছেন মুসলিম ও খ্রিস্টান ধর্মের নেতাদের সাথে।
জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের দখলে থাকাকালীন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল শহরগুলো। এখনো কাটিয়ে ওঠেনি যুদ্ধের ক্ষত। এ অবস্থায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের নিরাপত্তা ও সহাবস্থান নিশ্চিতের আহ্বান জানান পোপ।
রোববার ইরবিল শহরে আয়লান কুর্দির বাবা আব্দুল্লাহ কুর্দির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনি। যুদ্ধের সময় প্রাণ বাঁচাতে পরিবার নিয়ে সমুদ্রপথে দেশ ছেড়ে পালানোর সময় সাগরে নৌকাডুবিতে প্রাণ হারায় শিশু আয়লান কুর্দি। ছয় বছর আগে তুরস্কের একটি সমুদ্র সৈকতে তার ভেসে ওঠা মরদেহের মর্মান্তিক ছবি নাড়িয়ে দিয়েছিল সারা বিশ্বকে। আয়লান ছাড়াও ইউরোপে যাওয়ার পথে ওই নৌকাডুবিতে নিজের মা আর ভাইকেও হারান আব্দুল্লাহ।
এর আগে শনিবার ইরাকের পবিত্র নগরী নাজাফ শহরে দেশটির অন্যতম সুপরিচিত শিয়া নেতা গ্র্যান্ড আয়াতুল্লাহ আলি আল-সিস্তানির সাথে বৈঠক করেন পোপ।
এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী মুস্তাফা আল-কাদমিসহ ইরাক সরকারের অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথেও দেখা করেন তিনি।
পোপের সফরকে ঘিরে ইরাকে এ কদিন ছিল কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। মসুলে তার গাড়িবহরের সঙ্গে ছিল সাঁজোয়া সামরিক যান ও সাদা পোশাকের নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সার্বক্ষণিক টহল।
রোববার বিধ্বস্তপ্রায় মসুলের মুসলিম ও খ্রিস্টান বাসিন্দাদের সঙ্গে আইএসের বর্বর শাসনকালে তাদের জীবনযাত্রা নিয়ে কথা বলেন পোপ। ২০১৪ সালে আইএসের দখলে যাওয়ার আগে মসুলের কেন্দ্রস্থল ছিল যে চত্বর- সেটি এবং সেখানকার বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও গির্জার ধ্বংসস্তুপ ঘুরে দেখেন তিনি।
বেশির ভাগ ভবনের ভিত নড়বড়ে থাকায় সেগুলোতে ঢুকতে পারেননি তিনি। ইরাকি সেনাবাহিনী এবং আন্তর্জাতিক জোটের আইএসবিরোধী অভিযানে চূড়ান্ত পরাজয়ের আগে ২০১৭ সালে শহরটি গুঁড়িয়ে দেয় জঙ্গিরা। সে সময় খ্রিস্টানদের পাশাপাশি বিরোধিতাকারী মুসলিমদেরও নির্মমভাবে হত্যা করেছিল আইএস জঙ্গিরা।
এ প্রসঙ্গে পোপ বলেন, ‘সভ্যতার সূতিকাগার যে নগরী, সেখানে এরকম বর্বরতা, ধর্মীয় স্থাপনা ধ্বংস করে দেয়া এবং মুসলিম, খ্রিস্টান, ইয়াজিদিসহ লাখো মানুষকে হত্যা ও গৃহহীন করে দেয়ার মতো নির্মম ঘটনা অকল্পনীয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভ্রাতৃহত্যা নয়, ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরিতে; ঘৃণার বদলে ভালোবাসা আর যুদ্ধের চেয়ে যে শান্তি বড় সে বার্তা ছড়িয়ে দিতে বদ্ধপরিকর আমরা।’
এ সময় সরাসরি আইএসের কথা উল্লেখ করে পোপ বলেন, ‘ঈশ্বরের নাম নিয়ে রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়া আর ধ্বংসযজ্ঞ চালানো বিপথগামীরা আর কখনোই মানবতাকে চুপ করিয়ে দিতে পারবে না, এটাই প্রত্যাশা।
বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বাস ইরাকে। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা অভিযানের সময়ও দেশটিতে ১৫ লাখ খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীর বাস ছিল। আইএসের তাণ্ডবে এ সংখ্যা তিন লাখে নেমে আসে।
এদিন হেলিকপ্টারে চড়ে খ্রিস্টান অধ্যুষিত কারাকোশ শহরেও যান পোপ। ঘুরে দেখেন আইএসের এক সময়ের দখলকৃত শহরটি। পরিদর্শন করেন জঙ্গিদের গোলাগুলির আস্তানা হিসেবে ব্যবহৃত একটি গির্জাও।
পরে স্বায়ত্তশাসিত কুর্দিস্তানের রাজধানী ইরবিলে যান পোপ ফ্রান্সিস। সফরের শেষ আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে সেখানে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে একটি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত জনসমাবেশে অংশ নেন তিনি।
সমাবেশ শেষে জনতার উদ্দেশ্যে বলেন, ‘ইরাক সর্বদা আমার হৃদয়ে থাকবে।’
এ সময় তিনবার ‘সালাম’ শব্দটি উচ্চারণ করে ভাষণের ইতি টানেন পোপ; যার অর্থ হচ্ছে শান্তি।