রোহিঙ্গা সংকটের জন্য মিয়ানমারের ক্ষমতাচ্যুত রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চিকে দায়ী করেছে দেশটির সেনাবাহিনী।
সংবাদ মাধ্যম দি গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে এ খবর জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে হারানো ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোতে এ বার্তা পৌঁছে দিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে, ইসরায়েলের সাবেক গোয়েন্দা আরি বেন-মেনাশেকে।
চলতি সপ্তাহে নেইপিদোতে তার নিয়োগ সম্পন্ন হয়। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর পক্ষে এরই মধ্যে কাজও শুরু করেছেন ইরানে জন্ম নেয়া ইসরায়েলি-কানাডিয়ান এই লবিস্ট।
ওয়াশিংটনে বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে চলমান কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘ফরেইন লবি’।
তাদের বরাত দি গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ভাষ্য অনুযায়ী দেশটির অভ্যুত্থান পরবর্তী ‘প্রকৃত পরিস্থিতি’ পশ্চিমা বিশ্বের কাছে তুলে ধরবেন বেন-মেনাশে।
এ লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের নেতৃস্থানীয় দেশগুলোকে তিনি এই বার্তা দিচ্ছেন, মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী দেশটির গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি নিজেই।
১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের পর থেকে সেনাবাহিনীর নির্দেশে গৃহবন্দি আছেন সু চি। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে দেশটিতে এক মাসের বেশি সময় ধরে চলছে গণবিক্ষোভ। নিরাপত্তা বাহিনী আগ্রাসনে এ পর্যন্ত প্রাণ গেছে অর্ধশত আন্দোলনকারীর।
এ ইস্যুতে বিশ্বজুড়ে কাঠগড়ায় থাকা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরছেন বেন-মেনাশে। এজন্য সু চি সরকারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা ইস্যু এবং পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর চীনবিরোধী অবস্থানকে হাতিয়ার করেছেন বেন-মেনাশে।
ফরেইন লবিকে বলেছেন, ‘রাখাইনে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর সহিংস সেনা অভিযানের পেছনে কলকাঠি নেড়েছিলেন সু চি।’
তার দাবি, রোহিঙ্গাদের কোণঠাসা করতে সেনাবাহিনীকে প্রভাবিত করেছেন সু চি নিজে। রোহিঙ্গা নিপীড়নের পেছনে তারই হাত ছিল, সেনাবাহিনীর নয়।
২০১৯ সালে সুইজারল্যান্ডের হেগে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বরতার সাফাই গেয়েছিলেন শান্তিতে নোবেলজয়ী সু চি।
আবার বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে বেন-মেনাশে বলেছেন, ‘মিয়ানমারকে চীনের প্রভাববলয়ে ঢোকানোর ব্যবস্থা করছিলেন সু চি। যা ঠেকাতে বাধ্য হয়ে অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত নেয় সেনাবাহিনী।’
তিনি আরো বলেন, ‘মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কখনোই দেশকে চীনের হাতের পুতুল হয়ে থাকতে দেশকে দেখতে চায় না। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের চীনবিরোধী অবস্থানকে সমর্থন করে তারা।’
সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে বিশ্বজুড়ে সমালোচনার ঝড় বইছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর। অভিযোগ রয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধ, অবৈধভাবে গণতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা এবং কঠোরভাবে বিক্ষোভ দমন চেষ্টার।
এ প্রসঙ্গে সাবেক ইসরায়েলি গোয়েন্দার দাবি, ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।
বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে বেন-মেনাশে জানিয়েছেন, কানাডায় তার রাজনৈতিক পরামর্শ দানকারী প্রতিষ্ঠান ডিকেন্স অ্যান্ড ম্যাডসনের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে নেইপিদোর বর্তমান সেনা নিয়ন্ত্রিত প্রশাসন।
তার দাবি, অগ্রিম হিসেবে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে কাজটি নিয়েছেন তিনি। মিয়ানমারের শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের ওপর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা শিথিল করানো তার অন্যতম লক্ষ্য। এতে সফল হলে পাবেন আরও বিপুল পারিশ্রমিক।
বিভিন্ন দেশের বিতর্কিত সরকারের হয়ে সাফাই গাওয়ার লম্বা ইতিহাস রয়েছে বেন-মেনাশের। ৬৯ বছর বয়সী বেন-মেনাশে প্রথম আলোচনায় আসেন আশির দশকে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী রোনাল্ড রিগ্যানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব উস্কে দেয়ার অভিযোগ আছে ইসরায়েলি এই গোয়েন্দার বিরুদ্ধে।
১৯৮০ সালে তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন রোনাল্ড রিগ্যান। বেন-মেনাশে তখন বলেছিলেন, নির্বাচনে জয়ের জন্য ইরানে অপহৃত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের মুক্তি না দিতে ইরানি প্রশাসনের সাথে ষড়যন্ত্র করেন রিগ্যান।
জিম্বাবুয়ের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও দীর্ঘদিনের শাসক রবার্ট মুগাবে, সুদানের সামরিক জান্তা এবং ভেনেজুয়েলা, তিউনিসিয়া ও কিরগিজিস্তানের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের হয়েও কাজ করেছেন তিনি।
সব মিলিয়ে কয়েক দশকের দীর্ঘ পেশাজীবনে সংবাদ শিরোনামে বেন-মেনাশের নাম না ওঠার ঘটনাই বিরল। এক সময় যুক্ত ছিলেন অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গেও।