গত দুই দশকে বিশ্ব রাজনীতির প্রান্ত থেকে কেন্দ্রে চলে এসেছে চীন। নতুন সহস্রাব্দে এসে দেশটির অর্থনীতি পাঁচ গুণের বেশি বড় হয়েছে, যা ছিল বিস্ময়কর।
তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুনভাবে সম্পর্ক গড়ে ওঠা দেশগুলোর সঙ্গে বেইজিং প্রথম দিকে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করলেও পরে শত্রু বনে যায়। পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়ার মতো ঘনিষ্ঠ মিত্র বাদ দিলে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে চীনের সম্পর্কে চিড় ধরেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পত্রিকা ফরেইন পলিসির এক নিবন্ধে বিশ্লেষক সালভাটোর ব্যাবোনেস বলেন, চীনের জন্য এগুলো সংকটের আভাস। অন্তত ৭০টি দেশের সঙ্গে কৌশল ও কাঠামোগত উন্নয়নে বেইজিংয়ের নেয়া ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্প এখন থমকে গেছে। দক্ষিণ চীন সাগরে সংকট নিরসনে চীনের প্রস্তাবিত ‘নাইন-ড্যাস লাইন’ মেনে নিচ্ছে না বিবদমান কোনো দেশই।
অন্যদিকে গত বছর চীনের হংকং অধিগ্রহণের পর সেখানকার বাসিন্দাদের অভিবাসন দিতে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো।
চীনের হুয়াওয়ের পণ্য বর্জন করেছে অনেক দেশের টেলিযোগাযোগ সংস্থা। ছবি: সংগৃহীত
এরই মধ্যে চীনের হুয়াওয়ে ও জেডটিইর পণ্য বর্জন করেছে অনেক দেশের টেলিযোগাযোগবিষয়ক সংস্থা।
চীনের সম্ভাব্য হুমকিকে বিবেচনায় রেখে সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়ন করেছে ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান।
ফরেইন পিলিসি লিখেছে, কঠিন এই বাস্তবতার মধ্যেও নিজেদের সম্প্রসারণবাদ আরও জোরদার করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে চীন।নিবন্ধে বলা হয়েছে, চীনের এমন আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি রুখে দিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উচিত হবে ‘বিচক্ষণতার সঙ্গে নিষ্ক্রিয়তার নীতি’ প্রয়োগ করা। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বরাজনীতি থেকে আরও বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে চীন।চীনের ওপর চাপ প্রয়োগের চেয়ে এমন অসহিংস নীতি বেশি সফলতা বয়ে আনবে ওয়াশিংটনের জন্য। এই অবস্থায় চীনের ওপর কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নীতি হিতে বিপরীত হবে বাইডেনের জন্য।
নিবন্ধে মন্তব্য করা হয়, চীনের পররাষ্ট্রনীতির একটি বৈশিষ্ট্য হলো সংকটে উসকানি দেয়া ও পরিস্থিতি ঘোলাটে করে ফায়দা লুটে নেয়া। এমন অবস্থায় মার্কিন নীতি এমন হতে হবে যাতে চীনের উসকানি ও নৈরাজ্যের ফাঁদ এড়িয়ে যাওয়া যায়।
সংঘাত ও যুদ্ধের মাধ্যমে চীনা সরকারের পরাজয় কোনো বিশ্বশক্তিই চায় না। এমনকি সবচেয়ে ভয়াবহ কট্টরপন্থিরাও এর বিপক্ষে। একই সঙ্গে কোনো শক্তিধর দেশ বা জোটের পক্ষেও সম্ভব নয় বাইরে থেকে শক্তি প্রয়োগ করে চীনা কমিউনিস্ট পার্টিকে ক্ষমতার মসনদ থেকে সরিয়ে দেয়া।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের প্রত্যাশা, চীন তার মধ্যম উদারপন্থি নীতিতে ফিরে যাবে। ২০১২ সালের শেষ দিকে বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের ক্ষমতায় বসার আগ পর্যন্ত চীন এই নীতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল।
যত দিন পর্যন্ত চীনের কেন্দ্রীয় নেতারা মনে করবেন তাদের যাবতীয় সমস্যার মূলেই রয়েছে ওয়াশিংটনের বিমাতাসুলভ কূটকৌশল, তত দিন বেইজিংয়ের রাজনীতিতে সংস্কারের হাওয়া লাগার সম্ভাবনা নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ছাড়াই বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্কে দেখা দিয়েছে বৈরিতা। বিশ্বের অনেক দেশেরই চীনের আধিপত্যবাদের বিষয়ে বিরূপ মনোভাব রয়েছে। যদিও এদের অনেকের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক নেই বললেই চলে।
সালভাটোর বেবোনেস মন্তব্য করেন, চীনের আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির জবাবে সবচেয়ে কার্যকর হবে যুক্তরাষ্ট্রের ‘পরিকল্পিত নিষ্ক্রিয়তার নীতি’।
চীনের প্রভাব বলয় নিয়ন্ত্রণে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরোধ, সেনকাকু দ্বীপ নিয়ে জাপানের সঙ্গে চীনের সংকট, লাদাখ ইস্যুতে চীনের সঙ্গে ভারতের সংঘাত–এমন সব ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রভাব নেই।
একইভাবে দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যুতে চীনের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্তত পাঁচটি দেশের চলমান সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
প্রতিবেশী দেশের বাইরেও ইউরোপের একাধিক দেশের সঙ্গে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইস্যুতে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে চীন। লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর সঙ্গে সমুদ্রে মাছ ধরা ইস্যুতে ও আফ্রিকার একাধিক দেশের সঙ্গে উন্নয়ন সম্পর্কিত ঋণের বিষয়ে সংঘাত চরমে উঠেছে চীনের।
এশিয়ার দেশটির এমন সব সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি কোনো ইন্ধন খুঁজে পাওয়া যায়নি, এমন মন্তব্য করেন সালভাটোর বেবোনেস। তবে এর জন্য তিনি বেইজিংয়ের উসকানিমূলক আচরণ ও আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতিকেই দুষলেন।
তার মতে, জো বাইডেন প্রশাসনকে সবচেয়ে বেশি সজাগ থাকতে হবে, বেইজিং যেন যেকোনো ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য তৈরি করতে না পারে। তবে বিশ্বের শক্তিধর দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে চীনের উসকানির মুখে নিজেকে সংযত রাখা অবশ্যই বড় চ্যালেঞ্জ।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ফাইল ছবি
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের কঠোর ও দমনমূলক চীন-নীতি থেকে সরে আসতে হবে জো বাইডেনকে। একই সঙ্গে ওয়াশিংটন-বেইজিং সম্পর্ককে আরও বেশি সৌহার্দ্যপূর্ণ করে তুলতে হবে।
স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানিতে চীনের ওপর চাপানো করের বোঝা লাঘব করতে হবে। এতে করে ট্রাম্পের এমন বিমাতাসুলভ আচরণে ক্ষুব্ধ অন্য দুই দেশ জাপান ও তাইওয়ান আমেরিকান পররাষ্ট্র নীতিতে আস্থা ফিরে পাবে।
একটা বিষয় ওয়াশিংটনকে মানতে হবে, বাইরে থেকে চীন সরকারকে ধরাশায়ী করা যুক্তরাষ্ট্রসহ কোনো শক্তিধর দেশের পক্ষে সম্ভব নয়। দেশটির শাসক দলের পরাজয় হতে পারে অভ্যন্তরীণ কোনো সংকট থেকেই।