বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে ২০১৭ সালে কাতারে গিয়েছিলেন শাহিদ মিয়া। এ জন্য ঋণ করে প্রায় চার লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছিল তার পরিবারকে।
কর্মক্ষেত্রের কাছেই শ্রমিকদের জন্য নির্ধারিত একটি ভবনে থাকতেন শাহিদ। গত বছরের সেপ্টেম্বরে কাতারে প্রবল বৃষ্টি হয়। সে সময় ভবনটিতে পানি ঢুকে পড়ে। মেঝেতে জমে থাকা পানিতে বিদ্যুতের তার পড়ে ছিল। ভেজা মেঝেতে পা রাখার পর বিদ্যুৎস্পর্শে মারা যান ২৯ বছর বয়সী শাহিদ।
এদিকে এখনও কাতার যাওয়ার সেই ঋণের টাকা শোধ হয়নি। এর বোঝা টানছে শাহিদের পরিবার। তিনি যেখানে কাজ করতেন সেখান থেকেও মেলেনি কোনো ক্ষতিপূরণ।
মঙ্গলবার ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১০ বছর কাতারে কাজ করতে গিয়ে মারা গেছেন শাহিদ মিয়ার মতো সাড়ে ৬ হাজারের বেশি শ্রমিক। এদের বেশিরভাগই ২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপ উপলক্ষে চলা বিভিন্ন নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করছিলেন।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাণ হারানো প্রবাসী শ্রমিকদের বড় অংশ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা থেকে কাতার গিয়েছিলেন।
কাতারে বিদ্যুতস্পর্শে নিহত শাহিদ মিয়া। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান
পাঁচটি দেশের সরকারি পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, কাতার ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনের অনুমোদন পাওয়ার পর ২০১০-২০২০ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে প্রাণ হারিয়েছেন ৬ হাজার ৭৫০ জন শ্রমিক।
এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন ভারতের শ্রমিকরা। ১০ বছরে কাতারে কাজ করতে গিয়ে দেশটির ২ হাজার ৭১১ জন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। বাংলাদেশ থেকে কাজ করতে গিয়ে মারা গেছেন ১ হাজার ১১৮ জন। নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা থেকে যাওয়া শ্রমিকদের মধ্যে মারা গেছেন যথাক্রমে ১ হাজার ৬৪১ জন, ৮২৪ জন ও ৫৫৭ জন।
দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত পরিসংখ্যান
ফুটবল বিশ্বকাপ উপলক্ষে বিপুল নির্মাণ কাজ চলছে কাতারে। নতুন করে বানানো হচ্ছে সাতটি স্টেডিয়াম। এর পাশাপাশি বিশ্বকাপ দেখতে আসা দর্শকদের চাপ সামলাতে বানানো হচ্ছে নতুন বিমানবন্দর, রাস্তা ও হোটেল। ঢেলে সাজানো হচ্ছে গণপরিবহন ব্যবস্থা। এমনকি বিশ্বকাপ ফাইনাল ম্যাচ আয়োজন উপলক্ষে নতুন একটি শহরই গড়ে তুলছে কাতার।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যেন এই উৎসব প্রস্ততিরই বলি হচ্ছেন দক্ষিণ এশিয়ার গরিব শ্রমিকরা।
উপসাগরীয় দেশগুলিতে শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করে ফেয়ারস্কয়ার। সংস্থাটির পরিচালক নিক ম্যাকগিহান বলেন, ‘শুধু কাতার বিশ্বকাপ আয়োজনের অনুমোদন পাওয়ার কারণেই প্রবাসী শ্রমিকদের একটা বড় অংশ মারা গেছেন।’
গার্ডিয়ানের অনুসন্ধান বলছে, ৩৭ জন শ্রমিক মারা গেছেন স্টেডিয়াম নির্মাণ কাজে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই ‘কাজের বাইরে’ মারা গেছেন বলে দাবি বিশ্বকাপ আয়োজক কমিটির।
তবে শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করার সময়ই মারা গেছেন শ্রমিকরা।
কাতার সরকার বলছে, গত ১০ বছরে যেসব শ্রমিক মারা গেছেন তাদের বেশিরভাগেরই স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। শ্রমিকদের সুরক্ষায় সব ধরনের ব্যবস্থাই নেয়া হয়েছে।
প্রবাসী শ্রমিকদের অনুপাতে এই মৃত্যু হারকে স্বাভাবিক বলে দাবি করেছেন কাতার সরকারের একজন মুখপাত্র।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশিরভাগ মৃত্যুর ক্ষেত্রেই মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়নি। এতে করে মৃত্যুর আসল কারণ চাপা পড়ে গেছে।
গার্ডিয়ান বলছে, শ্রমিকদের অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর পেছনে কাতারের গরম আবহাওয়া অন্যতম কারণ। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) গবেষণাও এমন দাবিকে সমর্থন করে। আইএলওর মতে, কাতারে বছরে অন্তত চার মাস গরম থাকে।
২০১৪ সালে ‘হৃদরোগে মারা যাওয়া’ শ্রমিকদের ময়নাতদন্ত করার বিধান রেখে আইন প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছিলেন কাতারের একদল আইনজীবী। তবে সরকার এ দাবি এড়িয়ে গেছে।
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ভাষ্য অনুযায়ী, শ্রমিকদের মৃত্যুর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আহ্বানকেও এড়িয়ে গেছে দেশটি।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, কাতারে প্রবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুর ঘটনা রেকর্ড করার ক্ষেত্রেও অস্বচ্ছতা ও অবহেলা রয়েছে। রাজনৈতিক কারণেই দেশটির সরকার এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সরবরাহে অনিচ্ছুক।
গার্ডিয়ান দাবি করছে, তাদের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে কাতার প্রায় ২০ লাখ প্রবাসী শ্রমিককে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে, যারা দেশটির শক্তিশালী শ্রমশক্তি। দৃশ্যত এতো বেশি তরুণ প্রবাসী শ্রমিকের মৃত্যুর কারণ তদন্তেও ব্যর্থ হয়েছে দেশটি।
এদিকে স্টেডিয়াম নির্মাণের সময় শ্রমিকদের মৃত্যুর ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করে নিহতের সংখ্যাকে ‘ভুল’ বলে দাবি করেছে কাতার বিশ্বকাপ আয়োজক কমিটি।
এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক ফুটবল সংস্থা (ফিফা) বলছে, বিশ্বের অন্যান্য বড় প্রকল্পের তুলনায় ফিফার প্রকল্পে দুর্ঘটনা কম। ফিফার প্রকল্পে পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকে বলেও দাবি করেছে সংস্থাটি।