ভারতের দিল্লিতে মঙ্গলবার দিনভর বিক্ষোভ শেষে সন্ধ্যার পর রাজপথ ছেড়েছেন আন্দোলনরত কৃষকেরা। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের পর দিল্লিজুড়ে মোতায়েন হয়েছে আধাসামরিক বাহিনী।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দিল্লি ও হরিয়ানায় জারি হয়েছে সর্বোচ্চ সতর্কতা। মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট সেবা মধ্যরাত পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয় দিল্লি, হরিয়ানা এবং উত্তর প্রদেশে।
ভারতের ৭২তম প্রজাতন্ত্র দিবসে কৃষি আইনের প্রতিবাদে দিল্লিতে কৃষক সংগঠনগুলোর ‘ট্র্যাক্টর প্যারেড’ প্রশাসনের অনুমোদিত এলাকা ছাড়িয়ে গেলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়।
দিনভর খণ্ডযুদ্ধের সময় ট্র্যাক্টর দুর্ঘটনায় এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। সংঘর্ষে আহত হয়েছেন পুলিশের বেশ কয়েকজন সদস্য, তাদের মধ্যে এক জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রতি বছর দিল্লিতে সামরিক প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। দিল্লির প্রান্তে দুই মাসের বেশি সময় ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া কৃষকেরা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণে প্রজাতন্ত্র দিবসে এই সামরিক প্যারেডের আদলে ট্র্যাক্টর প্যারেডের ঘোষণা দেন।
অনড় কৃষকদের থামাতে আট দফা বৈঠক করেও সমাধানে পৌঁছাতে না পারা কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্ত হয়। সর্বোচ্চ আদালত নতুন তিনটি কৃষি আইনের ওপর স্থগিতাদেশ দিয়ে এগুলোর বৈধতা খতিয়ে দেখতে চার সদস্যের কমিটি করে দেয়। আর প্রজাতন্ত্র দিবসে কৃষকদের কর্মসূচি ঠেকানো প্রশ্নে আদালত জানায়, এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না তারা।
এমন পরিস্থিতিতে দিল্লি ও হরিয়ানা পুলিশ কৃষক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের কর্মসূচি পালনের জায়গা নির্ধারণ করে দিয়েছিল। তবে আন্দোলনকারীদের একটা অংশ তা না মেনে কার্যত গোটা দিল্লির দখল নিয়ে ফেলেন। রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় আইটিও চত্বর, নাংলোই এলাকা।
নজিরবিহীন পরিস্থিতি তৈরি হয় ঐতিহাসিক লালকেল্লায়। পুলিশের বাধা পেরিয়ে দুপুরের দিকে এক দল কৃষক ঢুকে পড়েন লালকেল্লা চত্বরে। পুরো চত্বর চলে যায় আন্দোলনকারীদের দখলে। চলতে থাকে স্লোগান।
এক পর্যায়ে ক্ষুব্ধ কৃষকেরা পৌঁছে যান লালকেল্লায় জাতীয় পতাকার কাছাকাছি। গম্বুজের মাথায় জাতীয় পতাকা উড়ছিল। নিচে ছিল আরও একটি পাইপ। সেই পাইপ বেয়ে উঠে সংগঠনের পতাকা টাঙিয়ে দেন এক জন। লালকেল্লার গম্বুজের উপরেও উঠে পড়েন অনেকে। আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়া সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা অভূতপূর্ব সাড়া দেয়ার জন্য কৃষকদের ধন্যবাদ জানিয়েছে। তবে অনভিপ্রেত ঘটনার জন্য তারা দুঃখ প্রকাশও করেছে। কিষাণ মোর্চা বলছে, ‘নির্ধারিত রুটের বাইরে এ ধরনের আন্দোলনের সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।’
পাঞ্জাবের একটি কৃষক সংগঠন কিষাণ মজদুর সংঘর্ষ সমিতি সোমবারেই ঘোষণা করে, সংযুক্ত মোর্চা ও দিল্লি পুলিশের মধ্যে আলোচনায় ট্র্যাক্টর মিছিলের যে রুট নির্দিষ্ট হয়েছে তা তারা মানবে না। তাদের সমর্থকেরা রিং রোড দিয়েই ট্র্যাক্টর নিয়ে যাবেন।
মঙ্গলবারের সহিংস বিক্ষোভের পর সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার অন্যতম নেতা ড. দর্শন পাল বলেন, ‘কিষাণ মজদুর সংঘর্ষ সমিতি মোর্চার সদস্য নয়।’মোর্চার আরেক নেতা জানান, ব্যারিকেড ভেঙে লাল কেল্লায় যাওয়ার জন্য উস্কানি দিয়েছেন পাঞ্জাবি অভিনেতা দীপ সান্ধু এবং গ্যাংস্টার থেকে সমাজকর্মী হওয়া জনৈক লাখা সরদানা।
দিল্লি পুলিশের যুগ্ম কমিশনার জানিয়েছেন, কৃষকদের হামলায় ১৮ পুলিশ কর্মী আহত হয়ে লোকনায়ক জয়প্রকাশ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।’
আইটিও এলাকায় ট্রাক্টর দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে উত্তরাখণ্ডের রুদ্রপুরের যুবক নবনীত সিংয়ের।
ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়নের মুখপাত্র রাকেশ টিকাইত বলেন, ‘আমরা জানি কারা অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছে, তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলের কিছু কর্মী আমাদের আন্দোলনকে কলুষিত করার চেষ্টা করছে।’
গত বছরের সেপ্টেম্বরে ভারতের পার্লামেন্টে পাস হয় নতুন তিনটি কৃষি আইন। এই তিন আইনের প্রথমটিতে সরকার নিয়ন্ত্রিত পাইকারি কৃষিবাজার কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে।
দ্বিতীয় আইন ফসলের আগে থেকে ঠিক করে রাখা দামে চুক্তিভিত্তিক চাষ বা কনট্রাক্ট ফার্মিংয়ের পথ প্রশস্ত করবে।
আর ব্যবসায়ী বা উৎপাদকেরা চাল-ডাল-আলু-পেঁয়াজ ইত্যাদি কতটা মজুত করতে পারবেন, সে বিষয়ে সরকারি নিয়ন্ত্রণ বিলোপ হবে তৃতীয় আইনের কারণে।
সরকারের বলছে, কৃষকের স্বার্থেই করা হয়েছে এসব আইন। তবে কৃষকদের দাবি, বড় ব্যবসায়ীদের আরও লাভবান করতেই আইনগুলো পাস করেছে নরেন্দ্র মোদি সরকার।