দিল্লি ঘিরে বসে থাকা কৃষকদের কোনো দাবি মানতে রাজি নয় সরকার।
কৃষি আইন বাতিল করা দূরের কথা, সরকার ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা এমএসপি নিয়ে আইনও করার দাবি মানতে রাজি নয়। কোনো দাবিই মানা হচ্ছে না দেখে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে কৃষক সংগঠনগুলো মঙ্গলবার ভারত বনধের ডাক দিয়েছে। তাদের সমর্থন করছে কংগ্রেস, এনসিপি, সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টি, ডিএমকে, আপ-সহ মোট ১৮টি বিরোধী দল।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস কৃষকদের দাবি সমর্থন করলেও বনধ সমর্থন করছে না। কারণ, তারা নীতিগতভাবে বনধের বিরোধী। সরকারের সঙ্গে বেশ কয়েক দফা আলোচনা করে এই সার-সত্যটা কৃষকরাও বুঝে গেছেন। তাই তাঁরা ভারত বনধ ডেকেছেন। মঙ্গলবার রাস্তা ও রেল অবরোধও হতে পারে। কৃষকরা তাদের শক্তি প্রদর্শন করতে বদ্ধপরিকর।
দিল্লিতে ট্যাক্সি ও অটোচালকদের কয়েকটি ইউনিয়ন বনধে শামিল হওয়ার ঘোষণা করেছে। ফলে দিল্লির রাস্তায় অটো ও ট্যাক্সি কম চলতে পারে। পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় বনধে ভালো সাড়া মিলতে পারে। দিল্লি পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জনজীবন স্বাভাবিক রাখতে সব ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
কৃষকদের বিক্ষোভ ক্রমশ তীব্র হতে থাকায় বিজেপিও এবার পাল্টা প্রচারে নেমেছে। আন্দোলন শুরু হওয়ার পর কৃষকদের 'খালিস্থানি' বা 'মাওবাদী' বলে চিহ্নিত করার কৌশল বুমেরাং হওয়ার পর এখন নতুন কৌশল নিয়েছে বিজেপি নেতৃত্ব।
কৃষকদের ডাকা ভারত বনধকে সমর্থন জানানোর জন্য বিরোধীদের নিশানা করতে আসরে নেমেছে বিজেপি। বিরোধীরা দ্বিচারিতা করছে বলে সোচ্চার হয়েছে তাঁরা। তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষকদের পাশে যে দলগুলো দাঁড়িয়েছে, তাদের অধিকাংশই অতীতে এ ধরনের অনেক আইন প্রণয়নকে সমর্থন করেছে, এমন কথাই বলেছে বিজেপি।
সোমবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা বিজেপির শীর্ষ নেতা রবিশংকর প্রসাদ সাংবাদিক বৈঠক করে অভিযোগ করেছেন যে, কৃষকদের একটা অংশ কয়েকটা লোকের কবলে পড়েছেন, যাঁদের নিজেদের স্বার্থ রয়েছে। ২০১৯ সালে কংগ্রেসের ইশতেহার পাঠ করে প্রসাদ বলেন, সেসময় কংগ্রেস এপিএমসি আইন বাতিল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
তাঁর দাবি, ২০১৩ সালে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী সব কংগ্রেসশাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন , এপিএমসি থেকে ফল-সবজি বাদ দিতে এবং খোলা বাজারে সরাসরি বিক্রি করতে দেয়ার জন্য। এনসিপি নেতা শরদ পাওয়ারকে নিশানা করে প্রসাদ বলেছেন যে, ইউপিএ সরকারের তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী তথা এনসিপি প্রধান মুখ্যমন্ত্রীদের চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, যাতে কৃষি ক্ষেত্রে বেসরকারি খাত অংশ নিতে পারে।
ভারতে কৃষকদের আন্দোলন। ফাইল ছবি
বিজেপি সূত্র জানাচ্ছে, কৃষকরা এই আন্দোলন খুব বেশিদিন টানতে পারবেন না। তাদের ধৈর্যচ্যূতি ঘটতে বাধ্য। তারা সেই দিনের জন্য অপেক্ষা করছেন। সরকার যে দাবি মানবে না, তা বুঝে যাওয়ার পর বেশিদিন আন্দোলন চালানো মুশকিল। কৃষকরা আন্দোলন করছেন বলে তাঁদের কিছু বলা হচ্ছে না। অন্যরা করলে তো এতদিনে উঠিয়ে দেয়া হতো। তাঁদের দাবিদাওয়া যে সরকার সহজে মানবে না, তা কৃষকরা ভালো করেই জানেন।
বিক্ষোভরত কৃষকরা খাবার-দাবার সঙ্গে এনেছেন। তাঁদের জমিতে ফসল পাকছে। বিশেষ করে আখ তোলার সময় এসে যাচ্ছে। সরকার তাই সময় নষ্ট করে তাঁদের ওপর চাপ তৈরি করতে চাইছে। কৃষকরা সাফ জানিয়েছিলেন, তাঁরা হেস্তনেস্ত করতে চান। কারণ, এই আইন তাঁদের সর্বনাশ করবে। ফলে তাঁরা বাঁচার জন্য লড়াই করছেন। সে জন্যই দিল্লির শীতে রাস্তায় শুয়ে পড়ছেন। পরিবার-পরিজন ছেড়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন।
এই চাপ ও পাল্টা চাপের খেলায় কে শেষ পর্যন্ত জিতবে তা পরে জানা যাবে। আপাতত একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, গত এক বছরে বিরোধী দলগুলো কোনো বিষয়ে একজোট হয়ে সরকারের বিরোধিতা করেনি। এই কৃষক আন্দোলন নিয়ে তাঁরা সবাই এক হয়েছেন। সবাই কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। দেশের ৬৭ শতাংশ মানুষ এখনও কৃষির ওপরে নির্ভরশীল। ফলে তাঁদের মন ও ভোট পাওয়ার জন্য বিরোধীরাও একজোট।
সমর্থন বিদেশ থেকেও আসছে। লন্ডনে কৃষকদের সমর্থনে বড়সড় বিক্ষোভ দেখিয়েছেন প্রবাসী ভারতীয়রা। নিউজিল্যান্ড, অ্যামেরিকাসহ বেশ কয়েকটি দেশে বিক্ষোভ হয়েছে। বিদেশ থেকে এ রকম সমর্থন পেয়ে কৃষকরা উজ্জীবীত বলে জানিয়েছেন।
উত্তর প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদব কৃষক যাত্রা করে কনৌজের কৃষকদের কাছে যেতে চেয়েছিলেন। লখনউতে বাড়ির পাশেই তাঁকে থামিয়ে দেয়া হয়। তিনি সেখানেই অবস্থান বিক্ষোভ শুরু করেছেন। এভাবে সরকার তাঁদের মনোভাব বুঝিয়ে দিয়েছে। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেডজরিওয়াল অবশ্য দিল্লি-হরিয়ানা সীমানায় গিয়ে বিক্ষোভরত কৃষকদের সঙ্গে দেখা করেছেন। তাদের আন্দোলনকে আপ যে সমর্থন করে সেটাও স্পষ্ট করে দিয়ে এসেছেন।