দীর্ঘদিন ধরেই ঘাড়ের ব্যথায় ভুগেছেন মাসুদ রানা। মাঝে মাঝেই ঘুম থেকে উঠলেই লক্ষ করেন ঘাড় নাড়াতে পারছেন না তিনি। আর তা নাড়ালে রগে টান লেগেছে এমন অনুভূতি হচ্ছে প্রায়ই। শোবার সময় কোনো সমস্যা ভেবে এড়িয়ে গেছেন বহুদিন। দুই/তিন বছর প্রায়ই এমন হওয়ার পর চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে বাধ্য হন তিনি।
বেশ কয়েকদিন ধরে কোমরের ব্যথায় ভুগছেন মিরপুরের বাসিন্দা রুমানা খান। সপ্তাহে একদিন হলেও এই সমস্যা হচ্ছে তার নিয়মিত। সিজারিয়ান অপারেশনের কারণে এমন হচ্ছে বলে ধারণা করছেন তিনি। কারণ ঠিক যে জায়গায় সিজারের জন্য এনেস্থিসিয়া দেয়া হয়, ব্যথাটা সেখানেই।
নিজেদের সমস্যাগুলোকে সাধারণভাবে নিলেও, সাধারণ মানুষের এসব সমস্যা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা।
প্রতি বছর ১৬ অক্টোবর বিশ্ব মেরুদণ্ড দিবস অর্থাৎ ‘ওয়ার্ড স্পাইন ডে’ বিশ্বব্যাপী পালিত হয় সর্বস্তরের মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য।
বর্তমানে আমাদের যে জীবনযাপন, তাতে দেখা যায় বেশিরভাগ সময় আমরা কর্মক্ষেত্রে বসেই কাজ করছি। এতে আমাদের চলাফেরা কম হচ্ছে, যা আমাদের শরীরের জন্যে মোটেও ভালো কিছু না।
আর এই বিষয়গুলোকে সামনে রেখে এবারের প্রতিপাদ্য করা হয়েছে ‘মুভ ইওর স্পাইন’।
ঢাকা সিটি ফিজিওথেরাপি হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. এম ইয়াসিন আলীর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করলে গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক একটি পরিসংখ্যান থেকে আমরা জানতে পারি, বিশ্বে প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো সময় ঘাড় বা কোমর ব্যথায় আক্রান্ত হন। সাধারণত কম বয়সীদের মধ্যেই আমরা এটি বেশি দেখতে পাই। শারীরিক নড়াচড়া বাড়লে শরীরের রক্ত সঞ্চালন বাড়ে। যার ফলে বিভিন্ন লিগামেন্ট শিথিল থাকে। সেক্ষেত্রে মেরুদণ্ডের সমস্যাও কম দেখা দেয়।’
কেন মেরুদণ্ডে ব্যাথা হয় এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা যদি মেরুদণ্ডের গঠন নিয়ে চিন্তা করি তবে বুঝতে পারবো, মাথার নিচ অংশ থেকে শুরু করে কোমরের নিচ অংশ পর্যন্ত ৩২ জোড়া ভার্টিব্রা বা কশেরুকা থাকে আমাদের শরীরে। এই ৩২ জোড়া হাড়ের সমন্বয়ে আমাদের মেরুদণ্ড গঠিত। ঘাড়ের অংশে ৭টি কশেরুকা, পিঠের অংশে ১৪টি, লম্বা অংশে থাকে ৫ জোড়া, এরপর সেকরাম ও ককসিস থাকে যা নিয়ে গঠিত হয় মেরুদণ্ড।
‘গঠন অনুযায়ী মেরুদণ্ড ঘাড়, পিঠ ও কোমরের নিচের অংশে একটু বাঁকা থাকে। এই গঠন অনুযায়ী আমরা নড়াচড়া করি। যেখানে মুভমেন্ট বেশি হয় সেখানে ক্ষয় বেশি হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘সেই অনুযায়ী ঘাড় ও কোমরের সমস্যা নিয়ে রোগী বেশি আসে চিকিৎসকদের কাছে। অনেকের ব্যথা ঘাড় হয়ে হাতের দিকে আসে, আবার অনেকের কোমর হয়ে পায়ের দিকে যায়। অনেক সময় প্যারালাইসিসও হতে পারে এ ব্যথার কারণে।
ঘাড় বা কোমরের ক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যায় দীর্ঘ সময় বসে কাজ করার পর হঠাৎ উঠতে গেলে মনে হয় ঘাড় বা কোমর আটকে গেছে। এর কারণ হলো মেরুদণ্ডের মুভমেন্ট যদি আমরা অনেকক্ষণ না করি সেক্ষেত্রে মাসল বা লিগামেন্টগুলো শক্ত হয়ে যায়। তখন সেই শক্ত মাসল বা লিগামেন্টগুলো নাড়াতে কষ্ট হয়।’
তিনি জানান, নারীদের ক্ষেত্রে কোমরের ব্যথা বেশি দেখা যায়। এর মূল কারণ কোমরের হাড় ক্ষয়। আর যাদের সিজারিয়ান অপারেশন হয়েছে, তাদের অনেকে মনে করেন সিজারের কারণে এই ব্যথা হয়। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।
মেরুদণ্ডের সমস্যা প্রতিরোধে কী করা যায়- এ প্রশ্ন আসতে পারে সবার মনেই। আর তার জবাব নিয়েই কথা বলেন ডা. এম ইয়াসিন আলী।
তিনি বলেন, ‘প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ জরুরি। কারণ প্রতিকারের কথা তখনই আসে যখন সমস্যা দেখা দেয়। আর সমস্যা দেখা দেয়ার আগেই যদি তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেয়া যায় তাহলে সমস্যা হবার সম্ভাবনাই অনেক কমে যাবে।’
তিনি জানা, সুস্থতার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলো শারীরিক মুভমেন্ট। অর্থাৎ, দীর্ঘ সময় টানা বসে না থেকে শারীরিক নড়াচড়া করা। দিনে কমপক্ষে ৩০ মিনিট হাঁটার কথা জানান তিনি। আবার অনেক ক্ষেত্রে স্থুলতার কারণেও মেরুদণ্ডের সমস্যাগুলো দেখা দেয়। তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই জরুরি। কাজের ফাঁকে সুব সাধারণ কিছু ব্যায়াম করা যেতে পারে যা বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা এড়াতে সাহায্য করবে।
প্রতিকার করার ক্ষেত্রে কী কী করা উচিত জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানান, যদি সমস্যা হয়েই যায় সেক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলো লক্ষ্মণগুলো দেখা দিলে প্রথম ধাপেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া। কারণ অনেকেই প্রথম দিকে বিভিন্ন সমস্যাকে গুরুত্ব দেন না। ফলে সমস্যাগুলো বড় আকার ধারণ করার সুযোগ পায়।
তিনি বলেন, ‘চিকিৎসার ক্ষেত্রে ওষুধের পাশাপাশি ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে মেরুদণ্ডের বিভিন্ন রোগ থেকে সুস্থ হওয়া যায়। তবে যেহেতু এটি বেশীরভাগ ক্ষেত্রে বয়স জনিত রোগ তাই এটি পুরোপুরি নির্মূল করা যায় না। তবে উপসর্গ কমিয়ে রোগীকে সুস্থ জীবন যাপন করানো যায় সহজেই।’
তিনি জানান, সুস্থ থাকার জন্য রোগীকে অবশ্যই কিছু নিয়ম কানুন মেনে চলতে হয়। যেমন- সামনের দিকে ঝুকে ভারী কাজ করা থেকে বিরত থাকা, ভ্রমনের সময় সাবধানে চলাফেরা করা যেন খুব বেশী ঝাকি না লাগে, নিচু হয়ে কিছু উঠানোর সময় হাঁটু ভেঙে বসে তা উঠানো ইত্যাদি।
মেরুদণ্ডের যেকোনো সমস্যা দেখা দিলে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে দ্রুত। এর জন্য ফিজিওথেরাপি সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা হিসেবে বিবেচিত। যদিও আমাদের দেশে ফিজিওথেরাপিস্ট অনেক কম। আবার অনেকে জানেন না যে কোন ডক্টরের কাছে যেতে হবে।
এ ক্ষেত্রে সচেতনতা বৃদ্ধি অনেক বেশি জরুরি বলে মন্তব্য করেন এই চিকিৎসক।