ডেঙ্গু রোগের বিস্তার এখন দেশজুড়ে। মশাবাহিত এই রোগে ইতোমধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৯৩ জন। আক্রান্তের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে গেছে। চলমান এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে এখন ঢাকার তুলনায় বাইরের জেলাগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেশি দেখা যাচ্ছে।
ঢাকায় দীর্ঘদিন ধরে এডিসের প্রকোপ থাকায় এখানকার বাসিন্দাদের অধিকাংশের শরীরে ডেঙ্গুর এন্ডিবডি তৈরি হয়েছে। অপরদিকে গ্রাম পর্যায়ে এডিসের বিস্তার নতুন এবং জনগণও এ বিষয়ে ততোটা সচেতন নয়। এ অবস্থায় সেখানে শঙ্কা বাড়ছে।
সরেজমিনে ঘুরে গ্রামে ডেঙ্গুর বিস্তারের নেপথ্যে কয়েকটি কারণের কথা জানিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার।
তিনি বলেন ‘গ্রামে ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির পেছনে প্রধানত চারটি কারণ আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি। প্রথমত, রাজধানী ঢাকায় অনেকদিন ধরেই ডেঙ্গুর প্রকোপ চলছে। সে কারণে ইতোমধ্যে এখানকার মানুষের এন্টিবডিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডেঙ্গুর সেরোটাইপ রয়েছে।
‘তাই এডিস মশার প্রকোপ সত্ত্বেও ঢাকায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী তুলনামূলক কম হবে। অপরদিকে ঢাকার বাইরে বিশেষত গ্রামাঞ্চলে ডেঙ্গুর প্রকোপ ক্রমশ বাড়বে। ইতোমধ্যে গ্রামাঞ্চলে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে।
ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘ঢাকায় ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপই সার্কুলেটেড হয়েছে। এতে ঢাকার মানুষের ইনফেকশন হওয়ার শঙ্কা কমে গেছে। তবে ঢাকার বাইরে সেগুলো নতুন। কারণ সেখানে চারটি সেরোটাইপের একটিও অ্যাটাক করেনি। সেক্ষেত্রে ঝুঁকি চার গুণ। আবার চান্স অফ ইনফেকশনও বেশি।’
এই কীটতত্ত্ববিদ বলেন, ‘ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা যখন ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় ট্রান্সফার হয়েছে তখন নতুন জায়গায় সেগুলো নিজের অবস্থান তৈরি করবে। বর্তমানে ঢাকার বাইরে এডিস মশার ঘনত্বও বেশি পাওয়া যাচ্ছে। বৃষ্টির পানি মানুষ বিভিন্ন জায়গায় জমিয়ে রাখছে। সেগুলো রান্নাবান্নায় ব্যবহার করছে৷
‘এখন পুকুরে আর সেভাবে পানি পাওয়া যায় না। নলকূপের পানিতে রান্না করলে কালো হয়ে যায় বলে বৃষ্টির পানি ধরে রাখে রান্নার কাজে ব্যবহারের জন্য।’
‘আবার দেখলাম মুরগির খাবার দেয়া হচ্ছে যেসব পাত্রে সে পাত্রে পানি জমে এডিস মশা জন্মেছে। ড্রামে ঢাকনা দিয়ে পানি জমিয়ে রেখেছে। সেই ঢাকনার মধ্যে এডিস পাওয়া যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এডিসের প্রকোপ ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।’
চলতি বছরের মাসিক তথ্য যা বলছে
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় ৫৬৬ জন। এর পর থেকে ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬, মার্চে ১১১, এপ্রিলে ১৪৩, মে মাসে ৫ হাজার ৯৫৬, জুলাইয়ে ৪৩ হাজার ৮৫৪ জন এবং আগস্ট মাসের ২১ তারিখ পর্যন্ত ৫০ হাজার ৩৫৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে।
ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষের হারই বেশি, ৬২ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, চলতি বছরের ২১ আগস্ট পর্যন্ত ১ লাখ ২ হাজার ১৯১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার তথ্য মিলেছে। তাদের মধ্যে ঢাকা সিটিতেই আক্রান্ত হয়েছে ৪৯ হাজার ৩২৮ জন। আর ঢাকার বাইরে ৫২ হাজার ৮৬৩ জন। ঢাকায় আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষ ২৯ হাজার ৭৯ জন। বাকি ২০ হাজার ২৪৯ জন নারী।
ঢাকা সিটির বাইরে এই সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। চলতি বছরে মোট আক্রান্তের মধ্যে ঢাকা সিটির বাইরে আক্রান্ত হয়েছেন ৫২ হাজার ৮৬৩ জন। তাদের মধ্যে পুরুষ ৩৪ হাজার ৬৬৯ ও নারী ১৮ হাজার ১৯৪ জন।
তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ায় সংখ্যার দিক দিয়ে কম হলেও এই রোগে নারীর মৃত্যু হার বেশি। এর মধ্যে সিলেট বিভাগে আক্রান্ত ও মত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সিলেটে আক্রান্ত হয়েছে ৫২ হাজার ৮৬৩ জন। তাদের মধ্যে মারা গেছেন ১২২ জন।
অপরদিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যু সবচেয়ে কম রংপুর বিভাগে। এই বিভাগে চলতি বছর মোট আক্রান্ত হয়েছে ২ হাজার ৮২ জন। মৃত্যু হয়েছে চারজনের।
রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ডে রোগীর ভিড়। ফাইল ছবি
চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ১ লাখ ৪ হাজার ৩৫৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ঢাকায় ৫০ হাজার ১৭০ জন এবং ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন ৫৪ হাজার ২৮৯ জন।
মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশে আরও ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। একইসঙ্গে এই সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ২ হাজার ১৬৮ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৮৪২ জন। আর ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৩২৬ জন।
মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
তাতে বলা হয়, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ৭ হাজার ৮২৯ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। তাদের মধ্যে ঢাকার সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ৩ হাজার ৫৭০ এবং অন্যান্য বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ৪ হাজার ২৫৯ জন।
এ পর্যন্ত আক্রান্তদের মধ্যে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৯৬ হাজার ৩৭ জন। তাদের মধ্যে ঢাকায় ৪৬ হাজার ২৩৪ ও ঢাকার বাইরে ৪৯ হাজার ৮০৩ জন রয়েছেন।
গ্রাম পর্যায়ে সচেতনতা জরুরি
কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, ‘গ্রামের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো অনেকের এই এডিস মশা সম্পর্কে ধারণাই নেই। কেউ কেউ এটাকে অন্য পোকা ভাবছে। এগুলো মানুষকে জানাতে হবে।
‘ইউনিয়ন পর্যায়ে যে স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো আছে, সেগুলোর মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে গ্রামের মানুষকে বুঝাতে হবে যে এগুলো এডিস মশা। এগুলো যেন না জন্মাতে পারে সেদিকেও সচেতনতা বাড়াতে হবে।’