বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে প্রথমবার কিডনি প্রতিস্থাপনে দাতার পরিচয় গোপন ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। কিডনিদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে যে সম্পর্ক দেখানো হয়েছে, সেটি আসলে মিথ্যা।
সম্পর্কে কিডনিদাতা ও গ্রহীতা ভাই না হলেও তাদের মধ্যে ভাই সম্পর্ক দেখিয়ে কিডনি দান করা হয়েছে। কিডনিদাতার নাম বলা হয়েছে সুসেন রায় এবং গ্রহীতা সুজন রায়। অথচ সুসেনের আসল নাম সুমিত হাওলাদার। এছাড়া তারা আসলে কোনো ধরনের আত্মীয়ও নন।
সম্প্রতি ঘটা এ ঘটনাটি নিউজবাংলাকে বুধবার নিশ্চিত করেছেন কিডনিদাতার আপন ভাই অমিত হাওলাদার।
বিএসএসএমইউ-এর একটি সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো পর্যায়ের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া এবং সম্পর্ক লুকিয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন করানো সম্ভব নয়। কারণ আইন অনুযায়ী শুধু পরিবার এবং নিকটআত্মীয় ছাড়া কেউ কিডনি দিতে পারেন না।
যেভাবে জানল পরিবার
কিডনিদাতার ভাই অমিত হাওলাদার বলেন, ‘প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপন সফলভাবে হয়েছে, এরকম একটি সংবাদ প্রচার হয় দেশের বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলে। সেটি দেখেই আমি আমার ভাইকে চিনতে পারি। সুমিতের স্ত্রীও টিভি দেখেই জানতে পারে বিষয়টি। পরে হাসপাতালে গিয়ে শুনি আমার ভাইকে বিদেশে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা কিডনি নিয়েছে।’
অমিত হাওলাদার এবং সুমিত হাওলাদার যমজ ভাই। তাদের বাড়ি ঝালকাঠি।
অমিত আরও জানান, তার ভাই সুমিত বিদেশে যাবেন বলে এক মাস আগে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। ওর স্ত্রী সীমা হাওলাদার বিআরবি হাসপাতালে চাকরি করেন। সুমিত বাসা থেকে বের হওয়ার সময় স্ত্রীকে বলে যান, তার বিদেশে যাওয়ার তারিখ ঠিক হয়ে গেছে। ১০ দিন ট্রেনিংয়ে থাকতে হবে।
সুমিতের স্ত্রী সীমা হাওলাদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার স্বামীকে শনিবার থেকে ফোন দিয়ে পাইনি। তখন একজন ফোন করে বলে সুমিতের ফোন পানিতে পড়ে গেছে। তিনদিন পর কথা বলবে। আমি বলি তাহলে তো সুজন দাদার সঙ্গে ট্রেনিংয়ে আছে, তার ফোন দিয়েও কথা বলা যায়। সুজনের ছেলে সাগরের ফোন দিয়েও বলা যায়। সে কিছু না বলায় আমি পরিচয় জানতে চাইলে ফোন কেটে দেয়।’
সেই নম্বরে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
সুজনের সঙ্গে পরিচয় কীভাবে-এই প্রশ্নে সীমা বলেন, ‘আমার স্বামী সুমিত একটা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চাকরি করতো। সুজন রায়ের কিডনির সমস্যা ছিল। আমার স্বামীর ওখানে চেকআপ করতে আসতো। সেই সূত্রে পরিচয়। সুজন গ্রিসে থাকতো৷ তার দুটো কিডনিই নষ্ট। আমার স্বামীকে কিডনির বিনিময়ে গ্রিসে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। আমি খবর দেখে হাসপাতালে গিয়ে সব জানতে পারি।
‘আমি কিছুই জানি না। যদি জানতাম, না খেয়ে থাকলেও স্বামীর একটা অঙ্গেহানি হতে দিতাম না।’
এখন আপনার বক্তব্য কী- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামীর একটা অঙ্গ নাই। মাত্র ৩০ বছর বয়স। আমার ৫ বছরের একটা মেয়ে আছে। যারা কিডনি নিয়েছে আমাদের সারা জীবনের ভরণপোষণ তাদের দিতে হবে।’
সীমা জানান, সুমিত চতুর্থ তলায় আইসিইউতে আছেন। সুজন রায় সাততলার পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডের (অস্ত্রোপচার–পরবর্তী ওয়ার্ড) আইসিইউতে আছেন। সুজনকে দেখাশোনা করছেন তার ছেলে সাগর।
কিডনি দান করা নিয়ে কাগজপত্র কীভাবে বানানো হয়েছে সে বিষয়ে সীমা বলেন, ‘ওখানে নাকি দুজন লোক ছিল। তারাই বানিয়ে দিয়েছে। আমাদের ধারণা তারা দালাল হতে পারে।’
এসব বিষয় সাগরের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে তিনি ফোন ধরেননি। এক পর্যায়ে তাকে হোয়াটসঅ্যাপে কল এবং মেসেজ দেয়া হয়, আপনার বাবার কিডনি প্রতিস্থাপন নিয়ে যে অনিয়মের অভিযোগ, সে ব্যাপারে আপনাদের বক্তব্য কী? আপনারা সব ভুল ডকুমেন্টস কীভাবে বানিয়েছেন বা কে সহায়তা করেছে- এই তথ্যগুলো দিয়ে সহায়তা করবেন।’
তবে এ মেসেজের পরও তিনি কোনো কথা বলেননি এবং মেসেজ সিন করলেও উত্তর দেননি তিনি।
যা বলছে প্রশাসন
সুপার স্পেশালাইজড হসপিটালের পরিচালক ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহ আল হারুন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা কোর্ট থেকে সমস্ত ডকুমেন্ট পেয়েই কিডনি প্রতিস্থাপন করেছি।’
তাহলে তার জাতীয় পরিচয়পত্র কী ভুল ছিল- এই প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে পরে কথা বলবো বলে রেখে দেন তিনি।
বিএসএমএমইউ উপাচার্য শরফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমি কোনো কাগজপত্র দেখিনি। তারা যা বলেছে সেই সূত্র ধরেই ভর্তি করেছি। তবে বিষয়টি জানার পর বুধবার চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। যে দোষী সাব্যস্ত হবে, তাকে শাস্তি দেয়া হবে।’
বিএসএমএমইউর সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে গত সোমবার কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। এটি ছিল এই হাসপাতালের প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপন। প্রযুক্তিনির্ভর অত্যাধুনিক চিকিৎসাসেবা দেয়ার লক্ষ্যে ‘সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠা করেছে সরকার।
এতে ব্যয় হয়েছে দেড় হাজার কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর ১৪ সেপ্টেম্বর এই হাসপাতালের উদ্বোধন করেন।
হাসপাতালটির প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপনের অস্ত্রোপচারে অংশগ্রহণ করেন ১৫ জন চিকিৎসক। এর নেতৃত্ব দেন কিডনি বিভাগের রেনাল ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জন অধ্যাপক হাবিবুর রহমান।