চিকিৎসা নিতে এসে মাহবুবা রহমান আঁখি ও তার সন্তানের মৃত্যুর ঘটনার পুরো দায় চিকিৎসকের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে সেন্ট্রাল হাসপাতাল। অপরদিকে চিকিৎসক সংযুক্তা সাহা দোষ চাপিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ওপর।
এমন পরিস্থিতিতে নতুন খবর দিয়েছে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)। প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার লিয়াকত আলী জানিয়েছেন, গাইনি বিশেষজ্ঞ সংযুক্তা সাহা অবৈধভাবে প্র্যাকটিস করছেন।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সংযুক্তা সাহার লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে ২০১০ সালে। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর লাইনেন্স নবায়নের বিধান থাকলেও তিনি তা করেননি। তাই আইন অনুযায়ী তিনি এতো বছর ধরে অবৈধভাবে প্র্যাকটিস চালিয়ে আসছেন। তাছাড়া রোগী আকৃষ্ট করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তিনি যে প্রচার চালিয়ে থাকেন তা-ও অনৈতিক।’
লিয়াকত আলী জানান, চিকিৎসক সংযুক্ত সাহার বিষয়টি নিয়ে আগামী শুক্রবার আলোচনায় বসবে বিএমডিসি। এরপর তার বিরুদ্ধে গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হবে।
একজন চিকিৎসক ১৩ বছর ধরে অবৈধভাবে প্র্যাকটিস করার পরও বিএমডিসি কোনো উদ্যোগ নেয়নি কেন- এমন প্রশ্নে সরাসরি কোনো উত্তর দেননি প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার।
এদিকে সেন্ট্রাল হাসপাতালে মা ও শিশুর মৃত্যুর ঘটনার পর থেকে সংযুক্তা সাহা আপাতত চিকিৎসা সেবায় যুক্ত থাকতে পারবেন না বলে প্রকাশিত খবরকে ভিত্তিহীন দাবি করেছেন ওই চিকিৎসক।
তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে এমনভাবে জনগণকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে যে আমি আর কোথাও চিকিৎসা সেবা দিতে পারব না। প্রকৃতপক্ষে এটা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এখতিয়ারে নেই। কোনো চিকিৎসকের সেবা বন্ধের ব্যাপারে একমাত্র সিদ্ধান্ত নিতে পারে বিএমডিসি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর শুধু বলেছে, আমি সেন্ট্রাল হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে পারব না।’
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হসপিটাল ও ক্লিনিক বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর দাউদ আদনান বলেন, ‘সংযুক্তা সাহার এই বক্তব্য সঠিক। কারও চিকিৎসা বা লাইসেন্স বাতিল করা আমাদের এখতিয়ারে পড়ে না। এটা বিএমডিসিই দেখবে। আমরা শুধু একটি ফরমাল লিখিত নোটিশ দিয়েছি। যেখানে হাসপাতাল পরিচালনার নির্দেশনা রয়েছে।
‘নোটিশে উল্লেখ রয়েছে- পরবর্তী নির্দেশনা ছাড়া তিনি সেন্ট্রাল হাসপাতালে কোনো বিশেষজ্ঞ সেবা দিতে পারবেন না। তার লাইসেন্স বাতিল বা তিনি কোথাও চিকিৎসা দিতে পারবেন না- এ ধরনের কোনো কথা নোটিশে বলা নেই।’
হাসপাতালকে দুষছেন ডা. সংযুক্তা
এদিকে সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উদ্ধৃতি দিয়ে রোগীর স্বজনদের বক্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন ডা. সংযুক্তা সাহা।
তিনি বলেন, ‘আমি সেন্ট্রাল হসপিটালকে ওপেন চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি- এখানে আমাকে নিয়ে মিথ্যাচার করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় ইস্যু হলো, আমি দেশেই নেই। অথচ রোগীর আত্মীয়-স্বজনকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছে যে আমি দেশেই আছি।
‘হাসপাতাল থেকে এ বিষয়ে আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। আমার অনুপস্থিতির বিষয়টি রোগী বা স্বজনদেরও জানানো হয়নি।’
আঁখির স্বজনদের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘মাহবুবা রহমান আঁখির স্বামী ইয়াকুব যখন বার বার জিজ্ঞেস করছিলেন যে সংযুক্তা ম্যাডাম কোথায় তখন হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে যে উনি ভেতরে আছেন। এ ধরনের মিথ্যাচারের কারণে তো মূল ফোকাস থেকে মানুষের দৃষ্টি সরে যাচ্ছে!’
এই গাইনি বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘সেন্ট্রাল হাসপাতালে রোগী ভর্তির কোনো লিখিত নিয়ম নেই। কার আওতায় রোগী ভর্তি হবে সেটা কনসার্ন ডক্টরের অনুমতি নিয়ে করার কথা। কিন্তু এই হাসপাতাল কৃর্তপক্ষ দীর্ঘদিন ধরেই প্রচলিত সেই প্রটোকল মানছে না। আঁখির ক্ষেত্রেও আমার কোনো অনুমতি নেয়া হয়নি।’
এতোসব জানার পরও আপনি এই হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছিলেন। এমনকি এসব অনিয়মের বিষয় বিএমডিসি বা মিডিয়াকেও কখনও জানাননি- এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. সংযুক্তা বলেন, ‘এর আগে এমন ঘটনা ঘটেনি।’
মা ও শিশুর মৃত্যুর ঘটনা সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে নিউজবাংলাকে ডা. সংযুক্তা বলেন, ‘হাসপাতালে ভর্তি হওয়া থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত আঁখির চিকিৎসার সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা ছিলো না। আমি কোথাও চিকিৎসা দিতে পারি বা না পারি আমি চাই সত্যিটা সামনে আসুক। আমার সুনাম ক্ষুণ্ন করার জন্য নানা কথা বলা হচ্ছে। আমার ১০ বছর আগের রোগী কেমন আছে, সেসব নিয়েও কথা বলা হচ্ছে। এসব বন্ধ হোক।
‘বাস্তবতা হলো, এখন পর্যন্ত আমার তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নেয়া অবস্থায় কোনো রোগীর মৃত্যু হয়নি। এরকম কোনো রেকর্ড নেই।’
প্রসঙ্গত, অন্তঃসত্ত্বা মাহবুবা রহমান আঁখিকে ৯ জুন কুমিল্লার তিতাস উপজেলা থেকে এনে সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাকে ভর্তি করা হয় চিকিৎসক সংযুক্তা সাহার অধীনে। তবে ডা. সংযুক্তার দেয়া তথ্যমতে, তিনি সে সময় দেশের বাইরে ছিলেন। অন্য চিকিৎসকেরা তার স্বাভাবিক প্রসব করাতে ব্যর্থ হয়ে পরে অস্ত্রোপচার করেন। এ সময় নবজাতকের মৃত্যু হয়। সংকটাপন্ন হয়ে পড়েন মাহবুবাও। পরে মারা যান তিনিও।
নবজাতকের বাবা ইয়াকুব আলী এ ঘটনায় মামলা করলে দুই চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাদের রিমান্ডে নেয়া হয়।
এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সেন্ট্রাল হাসপাতালে সব ধরনের অস্ত্রোপচার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সংযুক্তা সাহাও হাসপাতালে আপাতত কোনো বিশেষজ্ঞ সেবা দিতে পারবেন না বলে নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।