লিভারের একটি মারাত্মক রোগ লিভার সিরোসিস। এ রোগে প্রতি বছরই অনেকের মৃত্যু হয়। প্রাণঘাতী রোগটি কী এবং এটি কেন হয়, তা এক ভিডিওতে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হেপাটোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মেডিসিন, লিভার ও পরিপাকতন্ত্র রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ফরহাদ হোসেন মো. শাহেদ। পরামর্শগুলো তার ভাষায় পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করা হলো।
লিভার সিরোসিস কী
লিভার সিরোসিস লিভারের একটা রোগ, যেটা লিভারে যেকোনো ইনফেকশন (সংক্রমণ) বা যেকোনো একটা রোগ হলে এটা যদি ভালোভাবে চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে এটা আল্টিমেটলি লিভার সিরোসিসে টার্ন করে।
লিভার সিরোসিস হচ্ছে এমন একটা লিভারের কন্ডিশন যেখানে লিভার কাজ করে না। লিভারের স্বাভাবিক গঠন এবং কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।
বৈশিষ্ট্য
নরমালি লিভারের স্বাভাবিক কিছু টিস্যু থাকে। এ টিস্যুগুলো সিরোসিসে নষ্ট হয়ে শক্ত হয়ে যায়। এটাকে বলা হয় ফাইব্রোসিস এবং এ শক্ত টিস্যুগুলো কিছুদিন গেলে আস্তে আস্তে কতগুলো মডিউলের মতো ডেভলাপ করে। গোলাকৃতির মডিউল। ফাইব্রোসিস বা মডিউল, এগুলো হচ্ছে লিভার সিরোসিসের ক্যারাকটারিস্টিকস বা বৈশিষ্ট্য। এগুলো হলে আমরা বুঝে নিই যে, লিভার সিরোসিস হয়ে গেছে।
লিভার সিরোসিস হচ্ছে লিভারের একটা অ্যাডভান্সড ডিজিজ যেখান থেকে আর ফিরে আসা যায় না। এটা আল্টিমেটলি মানুষের মৃত্যুর একটা কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
লিভার সিরোসিস যাদের বেশি হয়
লিভার সিরোসিস পুরুষদের বেশি হয়; নারীদের কম হয়। সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখ মানুষ লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়। মানুষ যে সমস্ত কারণে মারা যায়, তার মধ্যে ১১তম হচ্ছে লিভার সিরোসিস।
লিভার শরীরে কোন কোন কাজ করে
১. লিভার আমাদের শরীরে ১০০টির ওপরে কাজ করে। এর মধ্যে প্রধান কাজ হচ্ছে পিত্তরস তৈরি করে, যেটা শরীরে হজমে কাজ করে।
২. তারপরে লিভার বিলিরুবিন, কোলেস্টেরল, হরমোন তৈরি করে এবং আমাদের শরীরে বিভিন্ন রকম ইম্পরট্যান্ট কাজ করে থাকে।
৩. প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট এগুলোর মেটাবোলিজম লিভারে সম্পন্ন হয়।
৪. লিভার প্লাজমা প্রোটিন তৈরি করে। এর মধ্যে কোয়াগুলেশন ফ্যাক্টরস অ্যান্ড অ্যালবুমিন। কোয়াগুলেশন ফ্যাক্টরগুলো শরীরে রক্তক্ষরণ বন্ধ করে। আর অ্যালবুমিন শরীরে পানি ধরে রাখে। ফলে লিভার সিরোসিসে অ্যালবুমিন কমে যায়। তখন শরীরে পানি চলে আসে।
৫. এ ছাড়া ভিটামিন, মিনারিল, গ্লাইকোজেন এগুলো লিভারে জমা হয়।
৬. আমাদের শরীরে লিভার এনার্জি অ্যাকটিভেশন বা এনার্জি সাপ্লাই (শক্তির জোগান) করে।
৭. মানবদেহে লিভার একটা ফিল্টার হিসেবে কাজ করে এবং ডিটক্সিফিকেশন করে। তার মানে আমরা যেকোনো ধরনের খাদ্য, পানীয়, ওষুধ গ্রহণ করি, এগুলো পাকস্থলী বা ইনটেস্টাইন থেকে লিভারে যায়। ওখানে ফিলট্রেশন (পরিশোধন) হয়। ফিল্টার হওয়ার পর যেগুলো বর্জ্যজাতীয় জিনিস, এগুলো ডিটক্সিফিকেশন হয়। এরপরে ব্লাডে যায়। কাজেই লিভার আমাদের ইম্পরট্যান্ট ফিল্টার হিসেবে কাজ করার কারণে আমাদের শরীরের অবিচ্ছেদ্য একটা অংশ।
লিভার সিরোসিসের কারণ
১. অনেকগুলো কারণে মানুষের শরীরে লিভার সিরোসিস হয়, তবে আমাদের দেশের জন্য যে কারণগুলো কমন, এগুলো হচ্ছে ক্রনিক হেপাটাইটিস-বি, ক্রনিক হেপাটাইটিস-সি। বি ভাইরাস এবং সি ভাইরাস যখন আমাদের শরীরে অনেক দিন ধরে থাকে, তখন এগুলো লিভার সিরোসিসে টার্ন করে। সাধারণত ভাইরাস গিয়ে অ্যাফেক্ট করার পর লিভার সিরোসিস হতে ১০ থেকে ১৫ বছর সময় লাগে। কাজেই কারও যদি বি ভাইরাস, সি ভাইরাস থাকে, এগুলো অবশ্যই আমাদের চিকিৎসা করা উচিত।
২. এর পরের কারণ হচ্ছে ফ্যাটি লিভার। ফ্যাটি লিভার আমাদের দেশে দুইভাবে হয়। অ্যালকোহলিক, নন-অ্যালকোহলিক।
অ্যালকোহলিক লিভার সিরোসিস: অ্যালকোহলিক মানে যারা অ্যালকোহল অনেক বেশি পরিমাণে খায় এবং অনেক দিন ধরে খায়। অ্যালকোহল থেকে লিভার সিরোসিসে টার্ন করে।
নন-অ্যালকোহলিক লিভার সিরোসিস: নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার হলো যাদের ওবেসিটি আছে, ওজন অনেক বেশি, হাইপারটেনশন আছে, ডায়াবেটিস আছে, থাইরয়েডের সমস্যা আছে, এ সমস্ত কারণে বা অন্যান্য অনেক হরমোনাল কারণে ফ্যাটি লিভার হয়। ফ্যাটি লিভার চিকিৎসা করা না হলে এটা আল্টিমেটলি লিভার সিরোসিসে টার্ন করে।
৩. অটোইমিউন কিছু ডিজিজ আছে। যেমন: অটোইমিউন হেপাটাইটিস, অটোইমিউন প্রাইমারি বিলারি সিরোসিস। এগুলোর চিকিৎসা করা না হলো লিভার সিরোসিসে টার্ন করে।
৪. জেনেটিক ডিজিজ। যেমন: উইলসন’স ডিজিজ
(লিভার, মস্তিষ্ক ও অন্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে তামা জমা হওয়া)। এগুলো পারিবারিকভাবে বংশ পরম্পরায় চলতে থাকে। এগুলোর চিকিৎসা করা না হলে লিভার সিরোসিস হতে পারে।
৫. এ ছাড়া কিছু ওষুধের কারণে লিভার সিরোসিস হয়। যেমন: একটা ওষুধ আছে যেটা স্কিন ডিজিজের জন্য খায়, অনেকে আথ্রাইটিসের জন্য খায়। এ ধরনের ওষুধগুলো লং টার্ম খেলে এগুলো থেকে লিভার সিরোসিস হতে পারে। এ ছাড়া আরও অন্য ওষুধ আছে। প্যারাসিটামল, এমিওডেরন। এ জন্য এ ধরনের ওষুধ যারা খান, তাদেরকে রেগুলার ফলোআপে থাকতে হবে। লিভার ঠিকঠাক আছে নাকি লিভার সিরোসিসে টার্ন হচ্ছে, রেগুলার চেকআপে থাকতে হবে।
৬. হার্টের রোগীদের যদি লিভারের মধ্যে ক্রনিক একটা কনজেশন থাকে, এটাও লিভার সিরোসিসে টার্ন করতে পারে। এভাবে আরও অনেক কারণ আছে লিভার সিরোসিসের।