চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী শুক্রবার থেকে শুরু হচ্ছে সিয়াম সাধনার মাস রমজান। এ মাসে অন্য অনেকের মতো ডায়াবেটিস রোগীরাও রোজা রাখবেন। সে ক্ষেত্রে তাদের করণীয় ও বর্জনীয়গুলো এক ভিডিওতে তুলে ধরেছেন ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের ভাসকুলার সার্জারি বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. সাকলায়েন রাসেল। পরামর্শগুলো তার ভাষায় পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হলো।
প্রস্তুতি
সবাই যারা সামর্থ্যবান মুসলিম, যাদের ওপর রোজা ফরজ হয়েছে, আমরা সবাই আসলে চাই এ সময়ে রোজা রেখে ওপরওয়ালার নৈকট্য লাভের যে সুযোগ, সেটা থেকে যেন আমরা কেউই বঞ্চিত না হই। এরই অংশ হিসেবে আমরা আসলে প্রতি বছর রোজা রাখি; রোজা রাখছি আমরা অনেকেই, কিন্তু যারা ডায়াবেটিস রোগী, তাদের মধ্যে অনেকগুলো প্রস্তুতির বিষয় আছে। তাদের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত অনেকগুলো গাইডলাইন প্রয়োজন।
যেমন: প্রথম কথাই হচ্ছে আপনি রোজা রাখবেন রমজান মাসে টানা এক মাস। আপনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগী। প্রস্তুতি শুরু করবেন কখন? উত্তরটা কিন্তু তিন মাস আগে। সেটা কী? আমি রোজা শুরু করার আগে আমার চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করে নেব যে, ‘আমি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত একজন রোগী। আমি রোজা রাখব। আমার জন্য কী কী উপদেশ আছে?’
উনি (চিকিৎসক) তখন আপনাকে চেকআপ করবেন এবং আপনার রেকর্ডগুলো দেখবেন, আপনার ডায়াবেটিস লেভেলটা ফ্লাকচুয়েট করে কি না, ওপরে-নিচে হয় কি না। আপনার কিডনিটা ভালো আছে কি না, আপনার অন্য কোনো রোগ আছে কি না। এগুলো যদি দেখে মনে হয় আপনি স্ট্যাবল (স্থিতিশীল) আছেন, সে ক্ষেত্রে আপনাকে কিন্তু উপারা সাজেস্ট করবেন যে, ‘হ্যাঁ, আপনি রোজা রাখেন। সে ক্ষেত্রে আপনার কোনো সমস্যা নাই।’
এখন যেহেতু হাতে আর সময় নেই, এই ভিডিওটি প্রথমবার যারা দেখলেন, তাদের হাতে মাত্র কয়েক দিন, কয়েক ঘণ্টা বাকি আছে। আমি তাদের ক্ষেত্রে বলব, আপনি তো জানেন আপনার রিসেন্টলি ডাটাগুলো কেমন, আপনার ডায়াবেটিস কেমন থাকছে, কমছে না বাড়ছে, ফ্লাকচুয়েশনটা কেমন হয়, এটা আপনি যদি মাথায় রাখেন, আমার মনে হয় টেনশন করার কোনো কারণ নাই।
সেহরি
এখন আসেন যে, কিছু টিপস দিব, খুব গভীরে যাব না। একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তি যদি মনে করেন যে, আমি সুস্থ আছি, আমার সব ঠিক আছে, আমি রাখতে চাই, কোনো বাধা নেই। আপনার যদি অন্য কোনো খারাপ কন্ডিশন না থাকে, রাখতে পারেন। রাখার ক্ষেত্রে যদি আমরা সেহরির কথা চিন্তা করি, সেহরিতে কী খাব? একদম সরাসরি কথা।
সোজা কথা হচ্ছে আপনি সেহরিতে যে খাবারটি গ্রহণ করবেন, আপনাকে মাথায় রাখতে হবে যে, আমি ১৪/১৫ ঘণ্টা একেবারেই না খেয়ে থাকব। তার মানে সেহরির সময় আমি এমন একটা খাবার গ্রহণ করব, যেটা মোটামুটি আমাকে লম্বা সময় এনার্জি দেয়।
সে ক্ষেত্রে কিন্তু দেখবেন যে, ভাতের থেকে রুটি কিন্তু বেশি সময় মানুষের শরীরে শক্তির জোগান দেয়। ভাত কিন্তু খুব দ্রুত শক্তি দেয় এবং খুব দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যায়। সে কারণে আমরা ভাতকে খুব একটা সাজেস্ট করি না।
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য আমরা সেহরির ক্ষেত্রে বলি আপনি একটু অপেক্ষা করেন। একেবারে আজান হওয়ার, অর্থাৎ সেহরির সময় শেষ হওয়ার একেবারে শেষ মুহূর্তে গিয়ে খাবেন। তাহলে আপনার জন্য সারা দিন রোজা রাখতে কষ্ট হবে না। তখন ডিউরেশনটা কম হবে। অনেকে রাত একটা-দুইটার মধ্যে খেয়ে ফেলেন। এটা ঠিক না। বিশেষ করে যারা ডায়াবেটিস রোগী।
সে ক্ষেত্রে খাবারের আইটেমের ক্ষেত্রে যদি সকালবেলা প্রবলেম না হয়, তারা যদি ফলমূল রাখতে পারেন, যদি খেজুর রাখেন, রুটিটা রাখেন, আমার মনে হয় যে, তিনি অনেক বেশি পুষ্টি বা এনার্জি নেয়ার একটা অবস্থায় থাকবেন।
সারা দিন না খেয়ে থাকব, সে জন্য কোনো অবস্থাতেই পেট ভরে খাব, চান্স পেয়েছি খেয়ে নিই, এমনটা যেন না হয়। তাতে দেখা যাবে যে, আপনার সকালবেলা পেট খারাপ হবে। তখন কিন্তু আপনি রোজাটাও রাখতে পারবেন না; প্রবলেমটা আরও বাড়বে। এমনিতেই অনেকের পেট খারাপ হয়। কারণ খাবারের প্যাটার্নটা চেঞ্জ হচ্ছে।
সকালবেলা আপনি ঘুম থেকে উঠবেন। সারা দিন থাকলেন। ডায়াবেটিস রোগীর জন্য ভয় কখন? ভয়টা হচ্ছে বিকেলের দিকে।
তার কিন্তু হঠাৎ করে হাইপো (রক্তে শর্করা কমে যাওয়া) হয়ে যেতে পারে। অনেক কমে যেতে পারে। কমে গিয়ে তিনি কিন্তু অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন। যদি মাথা ঘোরায়, চোখে অন্ধকার দেখেন, পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়, ঘাম হয়, এ সময় তো আল্লাহর বিধানই আছে। রোজা না রাখা আপনার জন্য সেই সময় দায়িত্ব। সেটা আপনি মেনে নিলেন।
টেস্ট
এখন সারা দিনে আপনি রোজা রাখছেন। মনে রাখতে হবে যে, আমি যে রোজা রাখলাম, আমার এখন তাহলে করণীয়টা কী? আমার তো পরীক্ষা করতে হবে। গ্লুকোজ টেস্ট করতে হবে। আমি রোজা রেখেছি। আমি কি পারব? এটার জন্য বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি অনেক আগেই সমাধান দিয়েছে। তারা বিশ্বের আলেম, বাংলাদেশের আলেমদের সাথে কথা বলে একটা চুক্তিনামা করেছে এবং তারা প্রমাণ করে দেখিয়েছে যে, ডায়াবেটিস রোগী যদি শুধু নিজেকে সুস্থ রাখার জন্য ব্লাড টেস্ট করে, রক্ত গড়িয়ে পড়ে না, তাহলে কিন্তু রোজার ক্ষতি হয় না। ফলে আমাদের সম্মিলিত আলেম সমাজের যে মতামত, সেটা অনুযায়ী কিন্তু যদি আপনার প্রয়োজন হয় জীবন রক্ষার্থে এবং একই সঙ্গে রোজা রাখার স্বার্থে, টেস্ট করতে পারেন। তাতে কোনো ক্ষতি নাই।
ইফতার
ইফতারের সময় আপনি কীভাবে কী করবেন? এটা জটিলতর একটা বিষয় যে, ইফতারের সময় তো আমার একটু ভাজাপোড়া না খেলে হবে না। আবার ওষুধ নিতে হবে। আবার একটু শরবত না খেলে কী রকম হয়? বলা হয়ে থাকে, যারা ডায়াবেটিস রোগী চেষ্টা করেন, যত কমসংখ্যক, একেবারে না খেলে আরও ভালো। ভাজাপোড়াটা অ্যাভয়েড করাটা সবচেয়ে ভালো।
যদি শরবতের দিকে আসি, চিনির শরবত কোনো দরকারই নাই। আপনি যদি ডাব একটা ম্যানেজ করতে পারেন, খুবই ভালো। যদি ডাব ম্যানেজ করতে না পারেন, একটু ফ্রুটগুলোকে জুস করে নিলেন, খুব বেশি সেখানে চিনি যোগ করলেন না, তাহলে কিন্তু আপনি অনেকটা ভালো খাবার গ্রহণ করলেন। চেষ্টা করবেন যে, ইফতারের পরপর কিছুটা বিশ্রাম নিতে।
রাতের খাবার
এখন নেক্সট কোশ্চেন আসে যে, আমি রাতের খাবারটা খাব কি খাব না? এটা আপনার ওপর নির্ভর করে। আপনি যদি মনে করেন যে, আমি ভালোভাবে ইফতার করেছি, আমি আর খেতে চাই না, ওকে; নো প্রবলেম। এটা নিয়ে টেনশন করার কোনো দরকার নাই।
এরপর কোশ্চেন আসে যে, ডায়াবেটিস রোগীর তো একটা হাইপো হওয়ার ভয়। আরেকটা কী ভয়? আরেকটা ভয় হচ্ছে তার শরীরে পানিশূন্যতা হতে পারে। সারা দিন তিনি পানি গ্রহণ করেননি। সেই ক্ষেত্রে তাদের জন্য টিপস হচ্ছে আপনি ইফতারের পর থেকে একবারে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত প্রতি ঘণ্টায় পানি গ্রহণ করবেন। তাতে কী হবে? আপনার ডিহাইড্রেশনটা ফিলআপ (পানিশূন্যতার ঘাটতি পূরণ) হয়ে যাবে এবং সকালবেলা (ভোররাত) আপনি যখন সেহরি করতে আবার উঠবেন, তার আগে কিন্তু টোটালি ফিলআপ। আপনি একদম ফিল ফ্রি।
ব্যায়াম
এবার আসল ব্যায়ামের কথা। সব মানুষেরই ব্যায়ামের প্রয়োজন। ডায়াবেটিস রোগীরা বাধ্য হন ব্যায়াম করতে। এ কারণে আমাদের শ্রদ্ধেয় ইব্রাহিম স্যার বলতেন, ‘আপনার ডায়াবেটিস হয়েছে। তার মানে আপনি ভাগ্যবান। কারণ আপনার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেড়ে গেল। কারণ সাধারণ মানুষ নিয়ম মানতে চায় না। ডায়াবেটিস হলে তখন সবাই নিয়ম মানে। তার আয়ু আল্লাহ হয়তো বা বাড়িয়ে দেন অথবা যতদিন তার আয়ু আছে, তিনি সুস্থ থাকেন।’ সো এটা এক দিক থেকে গুড নিউজ, ডায়াবেটিস আছে।
ব্যায়ামের ক্ষেত্রে যেটা করণীয়, সেটি হলো যে আপনার ব্যায়ামের সময় মনে রাখতে হবে যে, আমি অবশ্যই রাতের দিকে ব্যায়াম আমি করতে পারি, কিন্তু যদি আপনি চিন্তা করেন আমি ২০ রাকাত নামাজ, তারাবির নামাজ একেবারে ২০ রাকাতই প্রতিদিন পড়ব, কোনো দরকার নেই তাহলে (বাড়তি ব্যায়ামের)।
ওইটাই বড় ব্যায়াম। নতুন করে ব্যায়ামের আর কোনো প্রয়োজন নেই। সো যিনি ২০ রাকাত নামাজ পড়ছেন, তার কোনো দরকার নাই আলাদা করে ব্যায়াম করার।
কেউ যদি না মনে করেন যে, না আমার আলাদা করে করতেই হবে, তাহলে ইফতারের পরে হালকা রেস্ট নিয়ে উঠে একটু হালকা হাঁটাহাঁটি করলেন। এটাই এনাফ। এখন তো আমরা সবাই ঘরেই থাকছি; ঘরেই নিয়ে নিলে হবে।
ওষুধ
ওষুধ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আমরা যেটা বলি যে, আপনার সকালটা। আপনি সকালবেলাতে একটা ওষুধ গ্রহণ করতেন, ওইটা হয়ে যাবে আপনার ইফতারের সময়। তাই না? আর রাতেরটা হয়ে যাবে সেহরির সময়। তাইলে ধরেন যে, আপনি সেহরির সময় যে ডোজটা নেবেন, সেটা আপনি অরিজিনাল যে ডোজটা নিতেন, তার অর্ধেক নেবেন। অর্ধেক নেবেন কী কারণে? সেহরির সময় যদি আপনি ফুল ডোজ নিয়ে নেন, তাহলে কী হবে? সারা দিনে খুব দ্রুতই কিন্তু সুগারটা ফল করতে পারে। আমরা হাফ ডোজ দিচ্ছি তাইলে কী কারণে, যাতে বিকালের দিকে আপনি হাইপো না হন।
আপনার গ্লুকোজ লেভেল যাতে ফল না করে। সে কারণে আপনি রিগুলার ডোজ যেটা রাতে নিচ্ছেন, সেটার আপনি অর্ধেক নেবেন।
আর ইফতারে...আপনারা জানেন যে, কিছু কিছু ওষুধ আমরা ইফতারের, মানে খাওয়ার আধা ঘণ্টা পরে নিই। যেমন: সকালের নাশতাটাই তো আপনার ইফতার, তাই না? সকালের নাশতাটা ইজ ইকোয়াল টু ইফতার। তাহলে সকালে নাশতার আধা ঘণ্টা আগে আপনি ওষুধ খেতেন অন্য সময়। এখন কী করবেন?
খুবই সহজ। সেটা হলো আপনি পানিটা মুখে দিয়েই ওষুধটা নিলেন বা ইনসুলিনটা নিলেন, নিয়ে আপনি ইফতারটা দ্রুতই করে ফেলুন। এখানে ৩০ মিনিট অপেক্ষা করার কোনো দরকার নাই।