সোনালি আঁশ পাটের সঙ্গে বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য জড়িয়ে রয়েছে। বিশ্বের যেসব দেশে পাট উৎপাদিত হয়; তার মধ্যে বাংলাদেশও উল্লেখযোগ্য। পাট আঁশ ও রান্না উভয়ই উদ্দেশেই কাজে লাগে। পাটজাতীয় উদ্ভিদগুলো খাদ্য ও ওষুধ হিসেবেও সমানভাবে কার্যকর, নিরাপদ, মাদকমুক্ত, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হীন।
পাট পাতার রয়েছে নানা ব্যবহার; এর আছে ঔষধিগুণও। বাংলাদেশ সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভির্সের ওয়েবসাইটে এ নিয়ে একটি নিবন্ধে বিস্তারিত লিখেছেন বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের কারিগরি শাখার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জাকারিয়া আহমেদ ও ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সুরঞ্জন সরকার।
পাট পাতার ব্যবহার
শুষ্কপাটের পাতা চায়ের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ফিলিপাইনে সাধারণত বাঁশের অঙ্কুর ও অলিটোরিয়াসের জাতের পাটের পাতা এক সঙ্গে মিশিয়ে শাক হিসেবে খাওয়া হয়। উত্তর আফ্রিকায় ও মধ্যপ্রাচ্যে মালুখিয়া নামে পরিচিত কচি পাটপাতা সবুজ শাক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফারাওদের সময় থেকে পাট পাতা একটি প্রধান মিসরীয় খাবার। জাপানে পাটের শুকনো পাতা কফি এবং চায়ের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ইউরোপে স্যুপ তৈরিতে পাটের পাতা ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
পাটের পুষ্টিমান
পাটের পাতা শুধু শাক হিসেবেই নয় বরং পাটের পাতায় রয়েছে প্রচুর পুষ্টিগুণ যেমন- প্রচুর পরিমাণ আয়রন, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সেলেনিয়াম, ফসফরাস, ভিটামিন ই, কে,সি, বি-৬ ও নিয়াসিন। প্রতি ১০০ গ্রাম পাটপাতায় ক্যালরির পরিমাণ ৭৩ কিলোজুল, আমিষ ৩.৬ গ্রাম, লোহা ১১ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ২৯৮ মিলিগ্রাম ও ক্যারোটিন ৬৪০০ (আইইউ) আরো রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও খাদ্যআঁশ।
পাট পাতার ব্যবহার ও ঔষধিগুণ
পাট গাছের প্রতিটি অংশই ওষুধ হিসেবে কার্যকর। পাটপাতা শারীরিক অসুস্থতা যেমন- রেচক বা কোষ্টকাঠিন্য, মাথাব্যথা, চিকেনপক্স বা গুটিবসন্ত, ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং গুঁড়াকৃমি চিকিৎসায় পাটগাছের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করা হয়।
অন্ত্রের রোগ নিরাময়
পাটশাক, খাওয়ার রুচি বাড়িয়ে মুখের স্বাদ ফিরিয়ে আনে ও মেদ বৃদ্ধির আশঙ্কা কমায়। এর তেতো স্বাদ মুখের লালাক্ষরণ বৃদ্ধি করে কার্বোহাইড্রেডকে ভাঙতে সাহায্য করে হজমে সহায়তা করে।
পাটপাতাতে ঔষধি গুণাগুণ থাকার কারণে এটি তিক্ত টনিক হিসেবে পাকস্থলী প্রশমক, কোষ্টকাঠিন্য দূরীকারক, পাকস্থলীয় বায়ুনাশক বা রক্তনালির সংকোচক রোধক এবং অন্ত্রের অ্যান্টিসেপটিক ওষুধ হিসেবেও ব্যবহার করা হয়।
প্রাচীন ভারতবর্ষীয়রা পাটগাছকে ছাই করে, মধুর সঙ্গে মিশিয়ে অন্ত্র পরিষ্কার করার জন্য ব্যবহার করতেন। পাতার গুঁড়া, ৫-১০টি বীজদানা, গুঁড়া হলুদের সাথে সমান অংশে মিশিয়ে, আমাশা নিরাময়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। দেখা গেছে, এক গ্রাম পাটপাতা শুকনা আধকাপ পানিতে ভিজিয়ে কিছুক্ষণ পরে পাটপাতার পানি ছেঁকে খেলে আমাশয় রোগ ভালো হয়। তাছাড়া দেড় গ্রাম পরিমাণ পাট পাতার গুঁড়া ভাতের সঙ্গ খেলে বারবার টয়লেটে যাওয়ার প্রবণতা অনেকখানি কমে যায়।
এছাড়াও এক গ্রাম পাতা গুঁড়া এবং এক গ্রাম হলুদ গুঁড়া একসাথে মিশিয়ে ঠান্ডা পানির সাথে দিনে দুবার করে খেলে রক্ত আমাশয় ভালো হয়।
গবেষণায় প্রমাণিত, দেড় থেকে দুইগ্রাম পাটের বীজের গুঁড়া, এক চামচ মধু ও সিকি চামচ আদার রস একসাথে মিশিয়ে সামান্য ঠান্ডা পানির সঙ্গে তিন ঘণ্টা পর পর খেলে পেট খারাপ ভাল হয়; শুকনো গুঁড়া পাটের পাতা দুই গ্রাম ও এক গ্লাস কুসুম কুসুম গরম পানির সাথে সকালে বাসিপেটে খেলে কোষ্ঠ পরিষ্কার হয়।
অক্সিডেটিভ ক্ষতি থেকে শরীর রক্ষায়
গবেষকরা লাইকোপিন নামক একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পাট শাকে পেয়েছেন, যা খেলে শরীরে সৃষ্ট প্রদাহ কমে এবং অক্সিডেটিভ ক্ষতি থেকে শরীরের কোষগুলোকে রক্ষা করে বা শারীরিক প্রদাহ কমায়। পাটশাক মানবদেহে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা বাড়ায় এবং রোগ প্রতিরোধ করে।
হাড়ের ক্ষয় রক্ষায়
পাটশাকে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, সোডিয়াম ও অন্যান্য উপাদান পর্যাপ্ত পরিমাণে গবেষণায় পাওয়া গেছে এবং এই ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম হাড় সুগঠিত করে এবং হাড়ের ক্ষয় রোধ করতে সাহায্য করে, আয়রন ও সোডিয়াম হাড় গঠন ও ক্ষয়পূরণ করে হাড়ের ভঙ্গুরতা রোধ বিশেষ ভূমিকা পালন করে।ক্যান্সার প্রতিরোধ
বেশি করে গাছের পাতা ও ফল খেলে বিশেষত গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল এলাকায় ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস পায়। জাপানের গবেষকেরা পাটের পাতা থেকে দুটি অ্যান্টিটিউমার বর্ধিতকরণ যৌগ শনাক্ত করেছেন, যা হলো ফাইটোল এবং মনো-গ্যালাক্টোসিলডিয়াসিলগ্লিসারল।
গবেষণালব্ধ প্রমাণ থেকে পাওয়া যায়, গরম পানিতে সিদ্ধ পাট পাতার জুস অ্যান্টিটিউমার বর্ধিতকারী উপাদানের সক্রিয়তা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃদ্ধি করে এবং গরম পানিতে সিদ্ধ পাট পাতার জুস টিউমার বর্ধিতকারী রাসায়নিকের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে কার্যকর।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ পাটশাকে উচ্চ মাত্রায় পটাশিয়াম লবণ থাকায় রক্তসঞ্চালন ও রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে। এর জন্য উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা দূর হয়। পাটশাক রক্তের কোলেস্টেরল কমাতে সহায়তা করে থাকে এবং নিয়মিত পাটশাক খেলে হার্টঅ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে।