ঢাকার একটি নামকরা বেসরকারি হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দেখিয়ে বের হচ্ছিলেন আইনজীবী এনামুল করিম। মুহূর্তে তাকে ঘিরে ধরেন কয়েকটি ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা। চিকিৎসক প্রেসক্রিপশনে কী ওষুধ লিখেছেন জানার জন্য চলতে থাকে একের পর এক প্রশ্ন।
পরিস্থিতির আকস্মিকতায় বিব্রত এনামুল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি মফস্বলে থাকি। যেখানেই ডাক্তার দেখাই ওষুধ কোম্পানির মেডিক্যাল অফিসাররা প্রেসক্রিপশনের ছবি চান। ঢাকাতেও যতবার দেখিয়েছি প্রত্যেকবার এমন হয়েছে।
‘দুই বছর আগে এক ডাক্তার আমার প্রেসক্রিপশনে এমনও লিখে দিয়েছিলেন, একটি কোম্পানির ওষুধ ছাড়া অন্যটা কেনা যাবে না।’
বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে চিকিৎসকদের নানাভাবে প্ররোচিত করে তাদের উৎপাদিত ওষুধ প্রেসক্রাইব করার অভিযোগ পুরোনো। এ জন্য উপহারসহ নানা কৌশল প্রয়োগ করছে কোম্পানিগুলো। তাদের বিক্রয় প্রতিনিধিরা চেম্বারের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন অনেকটা পাহারার ভঙ্গিতে।
রাজধানীর কিছু হাসপাতাল ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের ভেতরে প্রবেশ নিষিদ্ধ করলেও বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেই প্রকাশ্যে চলে তাদের তৎপরতা। রাজধানীর কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন, উপহার-উপঢৌকনের বিনিময়ে নির্দিষ্ট কোম্পানির ওষুধ প্রেসক্রাইব করার যে চল তৈরি হয়েছে, তাতে তারা বিব্রত। তবে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করা কঠিন।
আর ওষুধ কোম্পানির বিপণন কর্মকর্তারা বলছেন, কোম্পানির টার্গেট পূরণ করতে তারা অনিয়মের আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এ কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় রোগী ও তাদের স্বজনের হাতে নিগ্রহের শিকারও হতে হচ্ছে।
প্রতিষ্ঠিত একটি কোম্পানির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মেডিক্যাল প্রমোশন অফিসার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের মাসিক একটা টার্গেট থাকে যে কয়টা প্রেসক্রিপশনে আমার কোম্পানির ওষুধের নাম লেখা হলো। সেটা ফিলাপ হলে আমরা বেতনের পরও ইনটেনসিভ পাই।’
রোগীর প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব ছবি দেখে কোম্পানি তার ওষুধের সঙ্গে অন্য কোম্পানির ওষুধের তুলনা করে দেখে কারটা বেশি লেখা হচ্ছে। এর ভিত্তিতে মার্কেটিং পলিসি ঠিক করা হয়। ডাক্তারকে কীভাবে মোটিভেট করা হবে, তাও ঠিক করা হয়।’
ওষুধ বিক্রি বাড়াতে চিকিৎসকদের বিভিন্ন ধরনের উপহার দেয়া হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কোনো ডাক্তার যদি একবার বলেন আমি লিটারেচার বাদে কিছুই নেব না, তাহলে আমরা দ্বিতীয়বার তার কাছে যাই না। এখানে তাদেরও চাহিদা আছে। আমি দু-একজনকে দেখেছি, যারা একটা কলম পর্যন্ত নেন না। তবে এই সংখ্যা খুবই কম।’
চিকিৎসকের বাইরে ফার্মেসির সঙ্গেও ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা সুসম্পর্ক রাখেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ফার্মেসির প্রধানের সঙ্গে আমরা সুসম্পর্ক রাখি, যাতে রোগীরা চাইলে আমাদের কোম্পানির ওষুধ কিনতে বলেন।’
একটি ওষুধ কোম্পানির রিজিওনাল সেলস ম্যানেজার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অনেক ডাক্তার গিফট যেমন- প্যাড, কলম কিংবা অন্যান্য ব্যবহারযোগ্য গিফট নিতে চান না। সে ক্ষেত্রে আমরা তাদের সাইন্টিফিক পেপার দিয়ে থাকি।’
উপহারের বিনিময়ে নির্দিষ্ট কোম্পানির ওষুধ প্রেসক্রাইব করার ঘটনায় বিব্রত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক শামসুজ্জামান।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ডাক্তারদের উচিত যে রোগীর ক্ষেত্রে যে ওষুধ লিখে তারা অভ্যস্ত সেটাই লেখা। তা না লিখে যদি কোম্পানির প্ররোচনায় গিফট পেয়ে অন্য ওষুধ যেটা হয়তো রোগীর খুব বেশি প্রয়োজন নেই, সেটা লিখলে রোগীর সমস্যাও হতে পারে।
‘তবে বিক্রয় প্রতিনিধির যোগাযোগের একটি ভালো দিকও আছে। সেটি হলো প্রোডাক্ট সম্পর্কে আপডেট হওয়া যায়। বাজারে নতুন একটি ওষুধ এলে সেটা যদি ভালো হয়, তা সবাই জানতে পারেন। তবে কোনো কিছুর বিনিময়ে যদি হয়, সেটি ম্যালপ্যাকটিস এবং অনৈতিক।
‘টাকা-পয়সা লেনদেন, বিদেশে ট্যুর, ছেলেমেয়ের বিয়ের খরচ দেয়া, বাড়ি করে দেয়া, গাড়ি গিফট করা- এগুলো আড়ালে চলছে। নির্দেশনা থাকলেও এসব বন্ধের কার্যকর উদ্যোগ নেই।’
এমন অবস্থা দূর করার উপায় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখান থেকে বের হতে গেলে ডাক্তারের পারমিশন ছাড়া কোনো ফার্মেসি ওষুধ দিতে পারবে না- এমন শক্ত বিধান করতে হবে। রেজিস্টার্ড ডাক্তার ছাড়া কেউ এন্টিবায়োটিক দিতে পারবেন না এবং প্রেসক্রিপশনে ওষুধের জেনেরিক নাম ব্যবহার করতে হবে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সহযোগী অধ্যাপক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রত্যেকটা কোম্পানি মার্কেটে প্রতিযোগিতা করছে। সবাই চায় তাদের প্রডাক্ট বেশি চলুক। সে জন্য ফার্মাসিউটিক্যালসগুলোর মার্কেটিং অফিসাররা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বিভিন্ন লিটারেচার যেমন- পেপার, গিফট এসব নিয়ে আসে। সেগুলোতে সেই কোম্পানির নাম প্রিন্ট করা থাকে।
‘টেবিলে রাখার জন্য শোপিস, কলম দেয়। এগুলো বারবার চোখে পড়ে এবং একজন ডাক্তারের মনের মধ্যে নামটি গেঁথে যায়। এর বাইরে কম্পিটিশন বেড়ে যাওয়ায় তারা এত বেশি এগ্রেসিভ হয়ে গেছে যে ডাক্তারদের সঙ্গে টাকা-পয়সার লেনদেনও চলছে।’
তিনি বলেন, ‘একজন মার্কেটিং অফিসার আমার কাছে আসতেই পারেন, তিনি প্রোডাক্ট সম্পর্কেও বলতে পারেন। কিন্তু টাকা-পয়সার লেনদেন পুরোপুরি আনইথিক্যাল।’
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের এই সহযোগী অধ্যাপক বলেন, ‘আমরা সত্যিকার অর্থেই বিব্রতবোধ করি, যখন দেখি দুই হাতে গিফটের ব্যাগ নিয়ে মার্কেটিং অফিসার দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে। অনেক সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, তারা এগুলো নিতে চান না এবং অস্বস্তি বোধ করেন। রোগীর স্বজনরা ফিসফাস করে। এটা নিয়ে চিকিৎসক সত্যিই বিব্রত।’
ইবনে সিনা হাসপাতালের গাইনি অ্যান্ড অবস বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মেডিক্যাল অফিসার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের হসপিটালে অন্য ফার্মা ঢুকতে পারে না। তবে আমি ইন্টার্ন করার সময় দেখেছি, বিভিন্ন ফার্মা স্যারদের টিভি, ফ্রিজ এমনকি তাদের ছেলেমেয়েদের বিয়ের খরচ থেকে শুরু করে বাথরুম ফিটিংস দেয় বিভিন্ন ফার্মা। তবে সবাই এসব গ্রহণ করেন না।’
আইন করছে সরকার
উপহারের বিনিময়ে চিকিৎসাপত্রে নির্দিষ্ট কোম্পানির ওষুধ লেখার প্রবণতা বন্ধে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব আনোয়ার হোসেন হাওলাদার।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ড্রাগ ল চূড়ান্ত করেছি, পরবর্তী পার্লামেন্টে এটি অনুমোদন পাবে বলে আশা করছি। এই আইনে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের ফার্মাসিউটিক্যালসগুলোকে লাইসেন্স দেয় ড্রাগ অথোরিটি। তারাই একমাত্র পারে এই কালচারটাকে বন্ধ করতে। এটা পৃথিবীর সব দেশেই আছে। তবে একেক জায়গায় একেক ফরম্যাটে। কাউকে বিদেশ পাঠাচ্ছে, কাউকে গবেষণায় সাহায্য করছে। এ জন্য তাদের নির্দিষ্ট বাজেট থাকে।
‘রোগীর এডুকেশন, ডাক্তারের এডুকেশন, জনসচেতনতা, সমাজ সচেতনতা এসব ক্ষেত্রে প্রোগ্রামের জন্য কোম্পানিগুলো ব্যয় করতে পারে। সেটা না করে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমাদের দেশের কোম্পানিগুলো প্রোডাক্ট প্রমোশনে সরাসরি খরচ করছে। গিফট বা গিফটের নামে তারা যা দিচ্ছে তা গ্রহণযোগ্য নয়।’
স্বাস্থ্যসচিব বলেন, ‘ডাক্তারদের গিফট দেয়া অবশ্যই আনইথিক্যাল। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না। এটি কোনোভাবেই অনুমোদিত নয়। এগুলো নিয়ে আমাদের বিভিন্ন আলোচনায় অনেকবার কথা হয়েছে।’
‘আমাদের ফার্মাসিউটিক্যালসগুলোর ভালো দিকও আছে। যেমন- ১৬টি দেশে ওষুধ রপ্তানি হয়। আর খারাপ দিক হলো এটার ম্যালপ্র্যাকটিস। চিকিৎসকরা যদি সত্যিই চান কোনোভাবেই উপহার গ্রহণ করবেন না, তাহলে এটা এমনিতেই কমে আসবে। অনেক সৎ চিকিৎসক রয়েছেন, তবে তারাও প্রেসারে পড়ে যান। আইন পাস হলে সব ধরনের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।’
এ ব্যাপারে ওষুধ প্রশাসনের বক্তব্য জানতে চাইলেও প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকর্তা মন্তব্য করতে রাজি হননি।