বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

উচ্চ রক্তচাপ: ফ্রি ওষুধে আশা, জোগান নিয়ে শঙ্কা

  •    
  • ৪ ডিসেম্বর, ২০২২ ০৯:৩৮

সিলেট, ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের ৫৪টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এখন মেলে উচ্চ রক্তচাপের ফ্রি ওষুধ। এর পাশাপাশি প্রাথমিকভাবে সিলেট জেলার চারটি উপজেলার আটটি কমিউনিটি ক্লিনিকে উচ্চ রক্তচাপের বিনা মূল্যের ওষুধ দেয়া শুরু হয়েছে। তবে রয়েছে ওষুধের সংকট।

দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার রানাপিংয়ের আফিয়া খাতুন। মাসছয়েক আগে এক প্রতিবেশীর কাছে জানতে পারেন, বিনা মূল্যে রোগের ওষুধ মিলছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। এরপর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে নাম নিবন্ধন করিয়ে টাকা ছাড়াই ওষুধ পান আফিয়া।

তিনি বলেন, ‘প্রথম দুই মাস স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ওষুধ পেয়েছি। এরপর বলা হলো বাড়ির পাশের কায়স্থরাইল কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে ওষুধ নিতে। সেখান থেকে দুই মাস ফ্রি ওষুধ আনি।’

নিবন্ধনের পর প্রথম কয়েক মাস বিনা মূল্যে ওষুধ পেলেও এখন তা পাচ্ছেন না বলে জানান আফিয়া। তার ভাষ্য, হাসপাতালে গেলেই বলা হয় ওষুধ নেই।

ভিন্ন অভিজ্ঞতা জেলার বিশ্বনাথের রামপাশার দিনমজুর কয়েস আহমদের। তার ভাষ্য, ‘আমি উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসে ভুগছি। এসব ওষুধ প্রতিদিন খেতে হয়, কিন্তু নিজের টাকায় উচ্চমূল্যের এসব ওষুধ কেনা সম্ভব নয়। ফলে আগে ওষুধ খেতে পারতাম না। ‘এ কারণে শারীরিক সমস্যা লেগেই থাকত, তবে গত চার মাস ধরে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে বিনা মূল্যে প্রেশার ও ডায়াবেটিসের ওষুধ দেয়া হচ্ছে। এতে অনেক উপকার পাচ্ছি।’

উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রোগীদের বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় ‘উচ্চ রক্তচাপ শনাক্তকরণ, চিকিৎসা এবং ফলোআপ’ কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৮ সালের অক্টোবরে। এতে সহায়তা করছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা রিজলভ টু সেইভ লাইভস (আরটিএসএল)।

সিলেট, ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের ৫৪টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এখন নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ (এনসিডি) কর্নারে মেলে এ সেবা। এর পাশাপাশি প্রাথমিকভাবে সিলেট জেলার চারটি উপজেলার আটটি কমিউনিটি ক্লিনিকে উচ্চ রক্তচাপের বিনা মূল্যের ওষুধ দেয়া শুরু হয়েছে।

গোলাপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সুদর্শন সেন বলেন, ‘আমাদের এখানে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিকস ও হৃদরোগের ফ্রি ওষুধের জন্য প্রায় ১০ হাজার রোগী নিবন্ধন করেছেন। প্রতিদিনই পাঁচ-ছয়জন করে রোগী বাড়ছে।

‘নিবন্ধন করা রোগীদের আমরা নিয়মিত খোঁজখবর নিই। কোনো রোগী এক মাস পর আর ওষুধ নিতে না এলে আমরা নিজেরাই যোগাযোগ করে তাকে আবার আসতে বলি।’

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এখন উচ্চ রক্তচাপের ওষুধের সংকট রয়েছে জানিয়ে এ চিকিৎসক বলেন, ‘আগে আমরা প্রত্যেক রোগীকে এক মাসের ওষুধ একবারে দিতাম। এখন তা পারছি না। কম করে দিই, ওষুধ নেই। সবাইকে সব দেয়া সম্ভবও হচ্ছে না।’

এর কারণ হিসেবে টার্গেটের চেয়ে বেশি রোগীর কথা জানিয়ে ডা. সুদর্শন বলেন, ‘এতে ওষুধের সংকট দেখা দিয়েছে। এখন ওষুধের সরবরাহও নেই। ফলে সব রোগীকে এখন ওষুধ দেয়া যাচ্ছে না।’

মাস দুয়েক ধরে এমন সংকট চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আগামী বছর থেকে আশা করছি সংকট দূর হয়ে যাবে।’

সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় ৭ হাজার ৩০০ রোগী নিবন্ধন করেছেন জানিয়ে এ উপজেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘আমরা এই প্রকল্পে প্রচুর সাড়া পাচ্ছি। রোগী বেশি হওয়ায় কিছু ওষুধের সংকট দেখা দিয়েছে। এনজিলক ও কোলেস্টেরলের একটি ওষুধ প্রায় দেড় মাস ধরে নেই। এ কারণে রোগীদের এসব ওষুধ দিতে পারছি না।’

প্রতিদিন গড়ে ৫০ থেকে ৬০ জন রোগী ফেঞ্চুগঞ্জে এই সেবা নিচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পার্শ্ববর্তী উপজেলা থেকেও অনেকে এই সেবা নিতে আসেন। ফলে আগেই ওষুধ শেষ হয়ে যায়। বছরে একবার আমাদের ওষুধ দেয়া হয়। সংকটে পড়লে আবার দেয়া হয়, তবে এ ক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগে।’

কীভাবে চিকিৎসা নেওয়া যায়এ সেবা নিতে নাম নিবন্ধনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানান ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলর স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. কামরুজ্জামান। তিনি জানান, যে কেউ ভোটার আইডি কার্ড নিয়ে এসে এনসিডি কর্নারে নাম নিবন্ধন করাতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে রোগী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এলে প্রথমে ডাক্তাররা দেখবেন। এরপর প্রেসার, ডায়াবেটিস বা হৃদরোগ থাকলে রোগীর নাম নিবন্ধন করা হয়।

ডা. কামরুজ্জামান জানান, এনসিডি কর্নার থেকে রোগীকে একসঙ্গে এক মাসের ওষুধ দেয়া হয়। এক মাস পরে এসে আবার ওষুধ নিতে পারেন তিনি।

রোগী কমিউনিটি ক্লিনিক থেকেও ওষুধ নিতে পারেন, তবে প্রথমে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসে নাম নিবন্ধন করাতে হয়। পরে কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে ওষুধ সংগ্রহ করা যায়।

৩১ ধরনের ওষুধ ফ্রি দেয়া হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন কিছু ওষুধ না থাকার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। ওষুধ এলে সবাই আবার নিতে পারবেন।’

সিলেটের চারটি উপজেলা বিশ্বনাথ, ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাইলট প্রকল্পের আওতায় ২০১৯ সাল থেকে এ সেবা চালু আছে বলে জানান সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. জন্মেজয় দত্ত।

তিনি বলেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে যাদের বাড়ি দূরে তাদের অনেকে ওষুধ নিতে নিয়মিত আসতে পারেন না। তাই এখন প্রতি উপজেলার দুটি করে কমিউনিটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এই সেবা চালু করা হয়েছে। এখন কমিউনিটি হাসপাতাল থেকেই ওষুধ নিতে পারছেন নিবন্ধন করা রোগীরা।

তিনি বলেন, ‘আগামী বছর থেকে সিলেটের সব স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও সব কমিউনিটি ক্লিনিকে এই সেবা শুরু করার লক্ষ্য আমাদের।’

ওষুধ সংকট সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ওষুধ ঢাকা থেকে পুরো এক বছরের জন্য কিনে পাঠানো হয়, কিন্তু যে পরিমাণ ওষুধ দেয়া হয় তার থেকে বেশি রোগী হয়ে গেছে। ফলে এক-দুই মাসের একটা গ্যাপ হয়ে যায়। এরপর সংকট দেখা দিলে আবার ওষুধ আসতে দেরি হয়ে যায়।

‘এখন আমরা চাচ্ছি ওষুধের যে সংকট তৈরি হবে, সেগুলো যাতে সিলেট থেকেই কেনা যায়, এই ব্যবস্থা করতে। আশা করছি, আগামী বছর থেকে তা সম্ভব হবে।’

সিলেট জেলায় এখন পর্যন্ত ৪৫ হাজার ৪০৪ জন নিবন্ধিত রোগী এই সেবা নিয়েছেন বলে জানান তিনি।

দরকার বাজেট বাড়ানোউচ্চ রক্তচাপ পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশব্যাপী এ বিষয়ে গণসচেতনতা তৈরি এবং সব কমিউনিটি ক্লিনিকে রক্তচাপ পরীক্ষা ও উচ্চ রক্তচাপের ওষুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে এ খাতে সরকারের বাজেট বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

তারা বলছেন, এ কর্মসূচি দেশব্যাপী সম্প্রসারণের মাধ্যমে হৃদরোগ, স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকির প্রধান কারণ উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ারের (সিবিএইচসি) লাইন ডিরেক্টর ডা. মাসুদ রেজা কবির বলেন, ‘ইতোমধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায়ে উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসাসেবা শুরু হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে দেশের সব কমিউনিটি ক্লিনিকে এই কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা সম্ভব হবে।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রাইমারি হেলথ কেয়ার অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটেড থানা হেলথ কমপ্লেক্সের পরিচালক ডা. তাহমিনা সুলতানা জানান, সীমিত পর্যায়ে কিছু কিছু কমিউনিটি ক্লিনিকে উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে, যা পর্যায়ক্রমে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া হবে। প্রকল্পটি সম্প্রসারণ করা হলে অল্প ব্যয়ে অনেক জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে।

উচ্চ রক্তচাপ কীরক্তচাপ যদি স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেক বেড়ে যায়, তাহলেই তা উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন। একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষের রক্তচাপ থাকে ১২০/৮০ মিলিমিটার পারদচাপ। রক্তচাপের মাত্রা দুটি ভিন্ন দিনে ১৪০/৯০ মিলিমিটার পারদচাপ বা তার বেশি হলে বুঝতে হবে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা রয়েছে, তবে বয়সভেদে রক্তচাপ কিছুটা কম বা বেশি হতে পারে।

গবেষণা কী বলছেবিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে ১২৮ কোটি মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে, যার দুই-তৃতীয়াংশ বাস করে বাংলাদেশসহ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে।

২০১৮ সালে করা বাংলাদেশ এনসিডি স্টেপস সার্ভের তথ্য বলছে, দেশে প্রাপ্তবয়স্ক প্রতি পাঁচজনের একজন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে জনগোষ্ঠীর ২১ শতাংশই উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। এদের মধ্যে ওষুধ খেয়ে রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছেন প্রতি সাতজনে একজনেরও কম।

২০১৯ সালে করা গ্লোবাল বারডেন অফ ডিজিজ স্টাডির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের প্রধান তিনটি কারণের একটি উচ্চ রক্তচাপ। এখানে বছরে ২ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ হৃদরোগজনিত সমস্যায় মারা যান, যার অন্যতম কারণ উচ্চ রক্তচাপ।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ অসংক্রামক রোগে মারা যায়, যার অর্ধেক হৃদরোগজনিত।

এ বিভাগের আরো খবর