দেশে লো কমোড বা প্যান কমোডকে সরিয়ে দিন দিন বাড়ছে হাই কমোডের ব্যবহার। মানুষের আর্থিক সামর্থ্য এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে উঁচু কমোড। তবে গ্রামে এখনও লো কমোডের প্রচলন বেশি।
টয়লেট এবং টাইলস সামগ্রী বিক্রির সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, লোকে এখন বাড়ি তৈরি করলে বাজেটের একটা বড় অংশ টয়লেটের পেছনে ব্যয় করে। আর প্রতিটি ফ্ল্যাটবাড়িতে একটির জায়গায় এখন দুই থেকে তিনটি টয়লেট থাকে, যেগুলোর বেশির ভাগে হাই কমোড যুক্ত করা হয়।
হাই ও লো কমোডের মধ্যে কোনটি বেশি স্বাস্থ্যসম্মত– এমন প্রশ্নের জবাবে ওয়াটারএইড বাংলাদেশের টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার তাহমিদুল ইসলাম নিউজবাংলাকে জানান, টয়লেটের প্যান অথবা কমোড দুটোই স্বাস্থ্যসম্মত। আসলে টয়লেটের যেটাতে পানি আটকে থাকে, সেটাই স্বাস্থ্যসম্মত। কারণ পোকামাকড়, মাছি এই পানিতে থাকা টয়লেট বর্জ্যের ওপর বসতে পারে না।
আজ ‘বিশ্ব টয়লেট দিবস’। ২০০১ সালে বিশ্বে টয়লেট ব্যবহার ও স্যানিটাইজেশন সম্পর্কে ক্যাম্পেইন শুরু করে ওয়ার্ল্ড টয়লেট অরগানাইজেশন (ডব্লিউটিও)। এরপর থেকে প্রতিবছর ১৯ নভেম্বর পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব টয়লেট দিবস। ২০১৩ সাল থেকে জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে এই দিবসের স্বীকৃতি দেয়। দিনটির উদ্দেশ্য স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার ব্যবহারে জনসচেতনতা বাড়ানো এবং ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য শৌচাগারের সুবিধা নিশ্চিত করা।
শতভাগ টয়লেট সুবিধা নিশ্চিতকরণের বিষয়টি মাথায় রেখে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ দিবসটি পালন করে থাকে। বাংলাদেশেও আজ দিবসটি পালিত হচ্ছে।
টয়লেট বা স্যানিটেশনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে বেশি। ভারতে যেখানে প্রায় অর্ধশত কোটি মানুষের টয়লেট নেই, সেখানে বাংলাদেশের প্রায় ৯৯ শতাংশ বাড়িতেই টয়লেট রয়েছে।
টয়লেট এখন দ্রুত বিকাশমান শিল্প
একসময় দেশে আধুনিক টয়লেট তো দূরের কথা, সাধারণ মানের টয়লেটও মানুষ ব্যবহার করত না। সেই দিন এখন পাল্টেছে। দেশে এখন ৭০ শতাংশ মানুষ মোটামুটি ভালো মানের টয়লেট ব্যবহার করে।
দেশে টয়লেট সামগ্রীর শিল্প এখন ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে। আগে এটি আমদানিনির্ভর থাকলেও এখন পুরোপুরি স্বনির্ভর। বাংলাদেশ এখন টয়লেট সামগ্রী রপ্তানিও করছে।
রাজধানীর বাংলামোটরে অবস্থিত টয়লেট সামগ্রীর দোকান কেলিফ সিরামিক। এর ম্যানেজার ওয়াদুদ বিশ্বাস নিউজবাংলাকে বলেন, দেশে এই ব্যবসা দিন দিন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেশির ভাগ পণ্য এখন দেশেই উৎপাদন হয়।
তিনি আরও বলেন, দেশে লো কমোডের দাম দুই-তিন হাজার থেকে শুরু হয়। আর হাই কমোডের দাম ছয়-সাত হাজার থেকে শুরু করে এক-দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত। তবে ১৫-২০ হাজারের মধ্যেই মানুষ বেশি কেনে।
বাংলাদেশ টাইলস ডিলারস অ্যান্ড ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এম ইউ গোলাম রাসুল বেলাল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্বাধীনতার পরে দেশের বেশির ভাগ মানুষ কোনো টয়লেটই ব্যবহার করত না। আর যারা ব্যবহার করত, তারা সিমেন্টের তৈরি লো কমোড ব্যবহার করত। কবে থেকে সিরামিকের কমোড দেশে ব্যবহার শুরু হয়, সেটা আমি বলতে পারব না। তবে আমার ধারণা ৯০ দশকের পর থেকে দেশে হাই কমোড ব্যবহার শুরু হয়। সে সময় দেশের ধনীরা বিদেশ থেকে এই কমোড আমদানি করে ব্যবহার করত। কিন্তু তখন এর চাহিদা ছিল খুবই কম।
‘সেই দিন আর নেই। এখন মানুষ বাড়ি তৈরিতে সবচেয়ে বেশি খরচ করে টয়লেটে। আগে যেখানে কয়েকটি পরিবারের জন্য একটি টয়লেট ছিল, এখন সেখানে প্রতিটা ফ্ল্যাটেই ২-৩টা টয়লেট থাকে। এর বেশিও থাকে।’
তিনি আরো জানান, শহরগুলোতে এখন লো-কমোডের ব্যবহার কমছে। হাই কমোডের ব্যবহার বেশি। শহরের একটা ফ্ল্যাটে তিনটা টয়লেট থাকলে দুটা থাকে হাই কমোড। আর একটা হয় লো কমোড। অনেক সময় তিনটাই হাই কমোড হয়। গ্রামে লো কমোডের ব্যবহার বেশি।
তিনি আরও জানান, টয়লেট পণ্যের বাজার দিন দিন বড় হচ্ছে। মানুষের রুচিও বাড়ছে। এখন মানুষ দোকানে এসে ভালো মানের কমোড কিনতে চায়। আগে যেখানে কোনো রকম একটা কমোড হলেই হতো, সেখানে এখন মানুষ দৃষ্টিনন্দন পণ্য খোঁজে। আগে যেখানে জেলা শহরে এক-দুইটা টয়লেট পণ্যের দোকান ছিল, এখন সেখানে শতাধিক দোকান।
স্যানিটেশনে বিপ্লব
খোলা জায়গায় মলত্যাগের হার দুই দশক ধরে বাংলাদেশে কমেছে। ২০২২ সালে প্রকাশিত জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের ১ দশমিক ২৩ শতাংশ মানুষ এখনও খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে। দেশের আট বিভাগের মধ্যে রংপুর বিভাগে খোলা জায়গায় মলত্যাগের হার সবচেয়ে বেশি ৪ দশমিক ৩১ শতাংশ। সবচেয়ে কম ঢাকা বিভাগে, শূন্য দশমিক ২৮ শতাংশ।
আগের তুলনায় উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগ বন্ধ হলেও মানব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এখন স্যানিটেশনের নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
ওয়াটারএইড বাংলাদেশের টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার তাহমিদুল ইসলাম নিউজবাংলাকে জানান, দেশে শতভাগ স্যানিটেশন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো যাদের যথাযথ টয়লেট নাই, তাদের টয়লেটের ব্যবস্থা করা। এরপর আসবে গ্রাম আর শহরে টয়লেট বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা। টয়লেট ব্যবহারের মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানো। কিন্তু টয়লেট ব্যবহার করেও যদি সেই বর্জ্য খাল, নদী ও পরিবেশে মিশে গিয়ে দূষণ সৃষ্টি করে, তাহলে সেই টয়লেট ব্যবহার সুফল বয়ে আনে না। তাই নিরাপদ স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করা আরেকটি চ্যালেঞ্জ।
তিনি বলেন, ‘এটা করতে গেলে শহরাঞ্চলে দুটো জিনিস লাগবে। একটা হলো নিরাপদ স্যানিটেশনের জন্য মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা। যেখানে একটি টয়লেটের সাথে যথোপযুক্ত একটা কনটেইনমেন্ট ব্যবস্থা থাকবে। অর্থ্যাৎ সেফটিক ট্যাংক বা পিট থাকবে। আর দ্বিতীয় হলো শহরে একটা বর্জ্য ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টসহ সঠিক ব্যবস্থাপনা থাকবে। বর্তমানে বাংলাদেশের হাতে গোনা কয়েকটি শহরে এ ধরনের ব্যবস্থা আছে। সরকারি পরিকল্পনায় এক শর ওপরে শহরে শিগগিরই বর্জ্য ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট চালু হবে। সে ক্ষেত্রে লক্ষ রাখতে হবে পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনগুলোয় কনটেইনমেন্ট থেকে প্ল্যান্টে আসা পর্যন্ত সঠিক ব্যবস্থাপনা আছে।
‘এখনও অসংখ্য শহর এই ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের বাইরেই রয়ে গেছে। এইগুলো যতক্ষণ আমরা করতে পারব না, ততক্ষণ আমাদের চ্যালেঞ্জটা রয়েই যায়। সুতরাং যত দ্রুত সম্ভব আমাদের ৩৩৭টি শহরেই এ ব্যবস্থাপনা করা দরকার।’