বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষ ফুসফুসের যে রোগে সবচেয়ে বেশি ভোগেন তার একটি নিউমোনিয়া। ১২ নভেম্বর বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে দিবসটি। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘নিউমোনিয়া সবাইকে আক্রান্ত করে।’
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ চেস্ট ডিজিজেস এবং হসপিটালের (এনআইডিসিএইচ) রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক আলী হোসেন জানান, নিউমোনিয়া দুই ধরনের হয়- ব্রঙ্কোনিউমোনিয়া ও লোবার নিউমোনিয়া।
ব্রঙ্কোনিউমোনিয়া সাধারণত শিশুদের এবং বেশি বয়স্কদের হয়। এই নিউমোনিয়ায় ফুসফুসের দুই অংশ সমানভাবে আক্রান্ত হয়। এটি শ্বাসনালীর যে বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা আছে, সেগুলোর আশপাশে হয়। এ কারণে এর নাম ব্রঙ্কোনিউমোনিয়া।
লোবার নিউমোনিয়া সাধারণত বয়স্কদের বেশি হয়। এতে ফুসফুসের একাংশ আক্রান্ত হয়।
ব্রঙ্কোনিউমোনিয়া লোবার নিউমোনিয়ার চেয়ে খুব বেশি মারাত্মক এবং এটাতে মৃত্যুহারও বেশি। কারণ এটি ফুসফুসের দুই অংশকেই আক্রান্ত করে এবং শিশু ও বেশি বয়স্কদের হয়। এই দুই গ্রুপেরই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। তাই মৃত্যুহার বেশি।
অধ্যাপক আলী হোসেন জানান, নিউমোনিয়ায় প্রাথমিকভাবে জ্বর, হাঁচি-কাশি হয়। অনেক সময় কফের সঙ্গে রক্ত যেতে পারে। এটি ফুসফুসকে আক্রান্ত করে ফুসফুস থেকে রক্তের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে শরীরের অন্যান্য জায়গায়। একে বলা হয় সেপ্টিসেমিয়া। যেটা নিউমোনিয়ার সবচেয়ে খারাপ দিক।
রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ার কারণে নিউমোনিয়ায় শ্বাসকষ্ট হতে পারে। ভাইরাল নিউমোনিয়া অনেক ক্ষেত্রে জটিল হয়ে সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন হয়। সে ক্ষেত্রে রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে।
নিউমোনিয়া কেন হয়, জানতে চাওয়া হলে অধ্যাপক আলী হোসেন বলেন, ‘নিউমোনিয়া ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস এই দুই সংক্রমণেই হতে পারে। ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে আমাদের ডায়াগনসিস করা সহজ হয়। কারণ এতে ব্লাড কাউন্ট ভীষণভাবে বেড়ে যায়। তবে ভাইরাল নিউমোনিয়া বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে ফুসফুসের দুই অংশই আক্রান্ত হয়।
‘কোভিড বা বার্ড ফ্লুতে যেসব নিউমোনিয়া হয়, এগুলো ভাইরাল নিউমোনিয়া। আর ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রে প্রোটিয়াস, স্টেপটোকক্কাস, স্টেফাইলোকক্কাস– এই ধরনের জীবাণু দিয়ে হয়। ভাইরাল নিউমোনিয়া শিশুদের রোটা ভাইরাস, রাইনোভাইরাস এসব কারণে হয়।’
রাজধানীর এম আর খান শিশু হাসপাতালের পরিচালক এবং নবজাতক ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এন কে ঘোষ সুমন বলেন, ‘নিউমোনিয়ায় রেসপিরেটরি ইনফেকশনে মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি। সারা বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশে নিউমোনিয়া ও অ্যাজমায় মৃত্যুহার বেশি।
‘শিশুরা ব্রঙ্কোনিউমোনিয়ায় বেশি আক্রান্ত হয়। এখন আমাদের দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় শিশুরা নিউমোনিয়ায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।’
প্রতিরোধ কীভাবে?
অধ্যাপক আলী হোসেন বলেন, ‘নিউমোনিয়ার টিকা রয়েছে আমাদের দেশে। দুই বছরের বেশি বয়সী সবাই টিকা নিতে পারে। আমাদের দেশে প্রিভেনার-১৩ এবং নিউমোভ্যাক্স-২৩ এই দুটি টিকা রয়েছে। এই টিকা সাধারণত পাঁচ বছর পর পর অথবা জীবনে একবার নেয়া যায়।’
দুই বছরের কম শিশুদের ক্ষেত্রে করণীয় জানতে চাইলে তিনি বলেন ‘এই ক্ষেত্রে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিতে হবে। যেমন- অপুষ্টি, ডায়রিয়া, হাম এগুলো সাধারণত শিশুদের হয়ে থাকে। সেগুলোর টিকা আছে। হামের টিকা দেয়া থাকলে নিউমোনিয়ায় সেটি কাজ করে। এ ছাড়া হুপিং কাশির ক্ষেত্রেও কাজ করে।’
এন কে ঘোষ বলেন, ‘দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্যও সরকারি টিকা রয়েছে, যেগুলো দেড় বছর বয়সে দেয়া যায়।’
প্রতিকার কী?
এন কে ঘোষ বলেন, ‘ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়ার চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমরা অ্যান্টিবায়োটিক দেই। এতে দ্রুত সুস্থ হয়ে যায়।
‘নিউমোনিয়ার অ্যাকচুয়াল ট্রিটমেন্ট হচ্ছে একটা সাপোর্টিভ, আরেকটা স্পেসিফিক। সাপোর্টিভের ক্ষেত্রে ন্যাজাল বা লিকুইড দেয়া হয়। স্পেসিফিকের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক। ভাইরাল নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ খুব বেশি কার্যকর নয়। সে ক্ষেত্রে প্রতিরোধ জরুরি।’
শীতে নিউমোনিয়া বাড়ে
আলী হোসেন জানান, ‘আমাদের দেশে নিউমোনিয়া নিয়ে সে রকম কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে যেহেতু এটি বিগ ফাইভ ডিজিজের অন্তর্ভুক্ত, তাই একে গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘সাধারণত শীতে নিউমোনিয়া বাড়ে। তবে আমাদের দেশে এখন টিকা চলে আসায় নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়া অনেকাংশে কমে গেছে। তবে ইদানীং অনেক রোগী দুটি ফুসফুস ইনফেকটেড হয় ভর্তি হচ্ছে। আবার তারা বেশির ভাগই সেরে যাচ্ছে। যদি তাদের ডায়াবেটিস বা অন্য কোনো অসুখ না থাকে, তাহলে বাসায় বসেই চিকিৎসা নেয়া সম্ভব। শুধু যাদের অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়, দুটি ফুসফুসের ৫০ শতাংশের বেশি আক্রান্ত হয়, তাদের ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয়া প্রয়োজন।’