দেশে রক্তের যে সংকট, তা থাকত না যদি জাকারিয়া বিশ্বাসের মতো আরও অনেক মানুষ থাকতেন। সেই ১৯৮৬ সাল থেকে শুরু। ৩৬ বছরে তিনি রক্ত দিয়েছেন ১১৮ বার।
প্রতি তিন মাস অন্তর রক্ত দেয়া যায় বলে যে কথা চিকিৎসকেরা বলে আসছেন, সেটি করে দেখিয়েছেন তিনি। কখনও সখনও তিন মাসের জায়গায় চার মাস হয়েছে, তবে নিয়মিত রক্ত দান থেকে দূরে থাকেননি তিনি।
খুলনার ঝিনাইখালী গ্রামের হাইস্কুল জেকেএজি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নৈশপ্রহরীর কাজ করতেন তিনি। চাকরি জীবন শেষ হয় ২০১১ সালে। ততদিনে রক্তদানকে অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেন তিনি।
শুরুটা যেভাবে১৯৮৬ সালে যশোরে জাকারিয়ার সামনে একটি দুর্ঘটনা ঘটে। আহত মানুষটিকে হাসপাতালে নিয়ে যান। তখন তার রক্তের দরকার ছিল। সে সময় তাকে রক্ত কিনে দেন জাকারিয়া। তিন দিন পর তাকে দেখতে গিয়ে দেখেন, সন্ধানী থেকে রক্ত দেয়া হচ্ছে হাসপাতালের সামনে। তাদের দেখেই রক্তদানে উৎসাহ পান, আর থামেননি।
প্রথম যখন রক্ত দেন, তখন তার বয়স ২৫। চিকিৎসকেরা বলেন, ১৮ বছর থেকেই দেয়া যায়। এখন জাকারিয়া আফসোস করেন, কেন আরও সাতটি বছর আগে জানলেন না এই তথ্য। তাহলে তার রক্তদানের সংখ্যাটি আরও বাড়তে পারত।
‘মানুষের ভালোর জন্য কাজ করতে চাই, তাই রক্ত দিই’স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবসে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সেমিনারে কথা হয় জাকারিয়ার সঙ্গে। সেখানে মোটামুটি তিনি তারকার মর্যাদা পেয়েছেন। সাধারণ বেশভূষার একজন মানুষকে সবাই শ্রদ্ধা করছে দেখার পর জানার আগ্রহ। পরে জানা যায় তার কীর্তির কথা।
নিউজবাংলাকে জাকারিয়া বলেন, ‘যশোরে আমার সামনে এক ব্যক্তির অ্যাক্সিডেন্ট হয়। পায়ে আঘাত লেগে রক্ত পড়ে অনেক। তখন তাকে রক্ত দিই। সেই থেকেই শুরু। আমি আগে জানতাম না কত বছর বয়স থেকে রক্ত দেয়া যায়। তাহলে ১৮ বছর থেকেই দিতাম।’
সে সময় বেশির ভাগ রক্ত কিনে দিতে হতো। আর এই কেনাবেচা দেখে স্বেচ্ছায় রক্তদানে উৎসাহ দিতে নিজের এলাকার মানুষদের উদ্বুদ্ধও করেন তিনি। রক্তদানে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সন্ধানীর শাখা খুলনাতেও চালু করেন তিনি।
সেই দুর্ঘটনায় আহত রোগীকে তিন দিন পর ফের হাসপাতালে দেখতে যাওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘তখন তারা আমাকে জানাল, সন্ধানী নামে একটি সংগঠন আছে সেখানে স্বেচ্ছায় রক্ত দেয়া যায়। আমি সেখানে রক্ত দেয়া শুরু করি। তখন ভাবলাম, আমি খুলনার ছেলে। খুলনায় সন্ধানী চালু করব। পরে সলিমুল্লাহ মেডিক্যালের কয়েকজন ছেলেকে নিয়ে যাই। তারপর সেখানে সন্ধানী চালু করি।’
জাকারিয়া বলেন, ‘রক্ত দিলে মানুষের জীবন বাঁচে। আমি মানুষের ভালোর জন্য কাজ করতে চাই। সে জন্য রক্ত দিই।’
খুলনার মানুষ হয়েও জাকারিয়া বেশি রক্ত অবশ্য দিয়েছেন ঢাকায় এসে। এর মধ্যে ঢাকা মেডিক্যালে ৪৮ ব্যাগ, সলিমুল্লাহ মেডিক্যালে ২৮ ব্যাগ, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হসপিটালে ৪ ব্যাগ, বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে ৫ ব্যাগ রক্ত দিয়েছেন।এর বাইরে খুলনায় ২০ ব্যাগ, যশোরে ৪ ব্যাগ রক্ত দিয়েছেন।
‘থ্যালাসেমিয়ার রোগী, সিজারের রোগী, দুর্ঘটনার রোগী এদের রক্ত দিয়ে আমার মোট রক্তদানের সংখ্যা ১১৮ ব্যাগ’-বলেন তিনি।
দেশে বছরে প্রায় ৮ থেকে ৯ লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন। বিপরীতে সংগৃহীত হয় ৬ থেকে সাড়ে ৬ লাখ ব্যাগ। বর্তমানে সন্ধানী, বাঁধনের মতো বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রক্ত সংগ্রহ কার্যক্রম চালালেও বছরে প্রায় ৩ লাখ ব্যাগ রক্তের ঘাটতি থাকে।
সংগৃহীত রক্তের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ আসে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের কাছ থেকে। একজন রক্তদাতা রক্ত দেয়ার মাত্র দুই-এক দিনের মধ্যেই ঘাটতি পূরণ হয়ে যায়। একবার রক্ত দিলে শরীর থেকে যে আয়রনের ঘাটতি হয়, সেটিও পূরণ হয়ে যায় কয়েক দিনের মধ্যে।
বয়স হয়ে যাওয়ায় এই রক্তের ঘাটতি পূরণ করতে আর ভূমিকা রাখতে পারবেন না বলে কিছুটা আফসোসও করেন জাকারিয়া। বলেন, 'এখন আমার বয়স ৬১ বছর। আর তো রক্ত দিতে পারব না। তবে মানুষের জন্য কাজ করে যাব।'
পেয়েছেন স্বীকৃতিওরক্ত দিয়ে মানুষের জীবন বাঁচানোর যে চেষ্টা, তার স্বীকৃতি মিলেছে বহুবার।
২০২০-২১ সালে সন্ধানী কেন্দ্রীয় পরিষদ সর্বোচ্চ রক্তদাতা হিসেবে সম্মাননা দেয়।
২০১৬ সালের গত ১৪ জুন ‘নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন দিবসে’ সর্বোচ্চ রক্তদাতা হিসেবে পুরস্কৃত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরর। এর আগেও তিনি বিভিন্ন সংস্থা থেকে পুরস্কৃত হয়েছেন।
২০১২ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় ‘সর্বোচ্চ স্বেচ্ছায় রক্তদাতা সম্মাননা ২০১২’, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের উদ্যোগে বিশ্ব রক্তদাতা দিবসের সম্মাননা ২০১৪, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে বোয়ান আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে হামদর্দের পক্ষ থেকে সম্মাননাও পেয়েছেন তিনি।