বর্ষা মৌসুম শেষে শরতে ডেঙ্গুর বিস্তারে রোগী ও মৃত্যু যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে তাতে ২০১৯ সালে মৃত্যুর রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া গিয়েছিল যে বছর, সে বছরের তুলনায় শনাক্তের বিপরীতে মৃত্যুর হার এখন পর্যন্ত দ্বিগুণ।
তিন বছর আগের তুলনায় রোগীর সংখ্যা এখনও এক-তৃতীয়াংশ হলেও মৃত্যু তুলনামূলক অনেক বেশি এবং প্রতি দিনই নতুন মৃত্যুর তথ্য দিচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, যদিও বছরের এই সময়ে এই ভাইরাসটিতে মৃত্যু বিরলই বলা যায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৯-এ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন এবং মৃত্যু হয় ১৮৯ জনের। অর্থাৎ শনাক্তের তুলনায় মৃত্যুর হার ছিল ০.১৮ শতাংশ। অর্থাৎ সে বছর প্রতি এক হাজার রোগীর মধ্যে ১ দশমিক ৮ জন মারা যায়।
২০২০ সালে শনাক্ত হয় ১ হাজার ৪০৫ জন, মৃত্যু হয় সাতজনের। শনাক্তের বিপরীতে মৃত্যুর হার ছিল ০.৪৯ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি এক হাজার রোগীর মধ্যে প্রায় পাঁচজনের মৃত্যু হয়।
২০২১ সালে শনাক্ত বেড়ে দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৪২৯ জনে। মৃত্যু লাফ দিয়ে হয় ১০৫ জনে। শনাক্তের তুলনায় মৃত্যুহার হয় ০.৩৭ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি এক হাজার রোগীর বিপরীতে শনাক্ত বেড়ে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৭ জনে।
চলতি বছর ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে ৩১ হাজার ৯৬৬ জন; এদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১১৮ জনের। অর্থাৎ শনাক্তের তুলনায় মৃত্যুর হার ০.৩৭ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি এক হাজার রোগীর বিপরীতে মারা যাচ্ছে ৩.৭ জন, যা মৃত্যুর রেকর্ড গড়া ২০১৯ সালের তুলনায় দ্বিগুণ।
বর্ষা শেষে ডেঙ্গুর এমন প্রকোপ আর কখনও দেখা যায়নি। সাধারণত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর বিস্তার থাকে। অথচ এবার এই রোগের বিস্তারের মূল শুরুটা হয় সেপ্টেম্বরে, আর অক্টোবরে বেড়েছে প্রকোপ।
এবার যে রোগী পাওয়া গেছে, তার মধ্যে ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ২৫ হাজার ৭৮৫ জনই পাওয়া গেছে সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরের এখন পর্যন্ত।
এর মধ্যে আবার বেশির ভাগই অক্টোবরে। এই মাসের ২৪ দিনে রোগী পাওয়া গেছে চলতি মৌসুমের অর্ধেক বা ১৫ হাজার ৮৭৪ জন।
যে মৃত্যু হয়েছে, তার অর্ধেক হয়েছে অক্টোবরের ২৪ দিনে। এই কয় দিনেই মারা গেছে ৫৬ জন, যা মোট মৃত্যুর ৪৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এই মাসে মৃত্যুহীন দিন ছিল কমই, যদিও মাসের মাঝামাঝি সময়ে ডেঙ্গু নির্মূল হয়ে যাবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা।
ডেঙ্গুর মৃত্যু এবার ২০১৯ সালকে ছাড়িয়ে যেতে পারে কেন, সেটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশারের বক্তব্যে উঠে এসেছে। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ডেঙ্গুর যে প্রবণতা তাতে আগামী ১৫ দিনেও তা কমবে, এমন বলা যাচ্ছে না। এখন থেকে সারা বছরই ডেঙ্গু থাকবে। হয়তো কোনো মাসে কম। কিন্তু ডেঙ্গু পাওয়া যাবে না এমন মাস আর পাওয়া না যেতেও পারে।’
ডেঙ্গুতে মৃত্যুর যে পরিসংখ্যানটি পাওয়া যায়, তার প্রায় সবই হাসপাতালে ঘটে থাকে। এতে মৃত্যুর প্রকৃত তথ্য উঠে আসে না বলে মনে করেন ইউনিভার্সাল মেডিক্যাল কলেজের রিসার্চ সেন্টারের প্রধান রেদওয়ানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে ঢাকার বাইরে যেসব রোগী আছেন তাদের ক্ষেত্রে সঠিক সংখ্যাটা জানা যায় না।’
বেশি মৃত্যু যেসব কারণে
এবার ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার ২০১৯ সালের মধ্যে দ্বিগুণ কেন, তার একটি জবাব পাওয়া যায় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইমেরিটাস প্রফেসর এ বি এম আব্দুল্লাহর বক্তব্যে।
তিনি জানান, ডেঙ্গুর যে কয়েকটি ধরন তার মধ্যে ডেন-থ্রি টা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এবার মানুষ এই ধরনটিতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।
দ্বিতীয় যে কারণ, সেটি হলো এবার যারা মারা যাচ্ছে তারা এর আগেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। যার ফলে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেছে।
তৃতীয় কারণ হলো শিশু ও নারীরা যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম ছিল।
ডেঙ্গুতে মৃত্যুর প্রধান কারণ রক্তের প্ল্যাটিলেট কমে যাওয়া, যে কারণে শুরু হয় রক্তক্ষরণ।
করোনার মতো এই ভাইরাসে আক্রান্তরাও যদি আগে থেকে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ক্যানসার, কিডনির মতো সমস্যায় ভোগেন, তাহলে মৃত্যুঝুঁকি বেশি থাকে।
ইউনিভার্সাল মেডিক্যাল কলেজের রিসার্চ সেন্টারের প্রধান রেদওয়ানুর রহমান জানালেন আরেকটি কারণ। তিনি মনে করেন, রোগীরা দেরিতে চিকিৎসার জন্য আসছে।
তিনি বলেন, ‘মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলব, রোগীরা হাসপাতালে দেরিতে আসে। সাধারণত ৪৮ ঘণ্টা পর ডেঙ্গু হলে জ্বর সেভাবে থাকে না। তাই অনেকেই মনে করেন রোগী ভালো হয়ে গেছে। কিন্তু রোগীর অবস্থা যে খারাপ সেটা বুঝতে পারে না। সেটা তিন-চার দিন পর যখন-তখন খারাপ হতে পারে। হাসপাতালে নিয়ে আসার পর ট্রিটমেন্ট দিতেও একটু দেরি হচ্ছে বা সঠিকভাবে দেয়া হচ্ছে না।’
২০১৯ সালেও রোগীরা দেরিতে চিকিৎসা নেয়ার কারণে ভুগেছেন বলে জানান রেদওয়ান। বলেন, "রোগীদের ‘ফাস্ট কন্টাক্ট ট্রিটমেন্ট’ অর্থাৎ শুরুতেই যে চিকিৎসা দেয়া হয়, সেটা সেবারও ভালোভাবে দেয়া হয়নি। এবারও আমরা সেই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারিনি।
“তাছাড়া অনেকে মনে করেন, প্ল্যাটিলেট কমে গেলে মৃত্যু হয়। তবে সেই সংখ্যাটা কম। সাধারণত রোগী শকে চলে গেলে তার মৃত্যু হয়। ৪৮ ঘণ্টা পার হওয়ার পর রোগী যখন শকে চলে গিয়ে মাল্টি অর্গান ফেইলিওরে চলে যান তখন আর ডাক্তারদের হাতে কিছু থাকে না। তা ছাড়া ডেঙ্গুতে সাধারণত মৃত্যু হয় না।”
ডেঙ্গু নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তাদের মধ্যে অন্যতম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, ‘এ বছর আমরা দেখতে পাচ্ছি মৃত্যু বেশি হচ্ছে ঢাকা ও কক্সবাজারে। ঢাকায় ঢাকা মেডিক্যাল ও সলিমুল্লাহ মেডিক্যালে বেশি। সাধারণত তিনটি কারণে মৃত্যু বেশি হতে পারে:
১. সঠিক সময়ে হাসপাতালে না আসা। অর্থাৎ অনেকে বুঝতেই পারেন না হাসপাতালে কখন যেতে হবে। ডেঙ্গু প্রথম তিন দিনের মধ্যেই পরীক্ষা করাতে হয়। আর জ্বর কমতে থাকলে প্ল্যাটিলেট কমে যায়, তখন চিকিৎসা নিতে এলেও ডাক্তারদের কিছু করার থাকে না।
২. আরেকটি কারণ হতে পারে, যারা চিকিৎসা দিচ্ছেন তারা ডেঙ্গু বিষয়ে বিশেষজ্ঞ না। এটি মফস্বলের ক্ষেত্রে বেশি। ঢাকার ডাক্তাররা এই বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলেছেন। কক্সবাজারে আগের বছরগুলোতে ডেঙ্গুর চিকিৎসার ব্যাপারে সে রকম অভিজ্ঞতা হয়নি চিকিৎসকদের।
এবং
৩. ডেঙ্গুর ধরন। ভাইরাসটির কয়েকটি ধরন আছে। সেরো টাইপ-ওয়ান, টু, থ্রি ও ফোর। যারা আগের বছর ওয়ান বা টুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন তারা যদি পরের বছর থ্রি বা ফোরে আক্রান্ত হন, তাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে।
কারণ যে ধরনটিতে তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন সেটির এন্টিবডি শরীরে তৈরি হয়ে যায়। তাই সেই ধরনটিতে আবারও আক্রান্ত হলে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার একটি ক্ষমতা শরীরে তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু অন্য কোনো ধরনে আক্রান্ত হলে সেটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শক্তি অনেক কম থাকে। তাই ঝুঁকিও অনেক বেশি থাকে।
এই কীটতত্ত্ববিদ জানান, বাংলাদেশে ২০১৯-এ সেরোটাইপ থ্রি বেশি হয়েছিল। এবার ঢাকায় থ্রি এবং ফোর দেখা যাচ্ছে। গবেষণায় ডেন-থ্রি দেখা যাচ্ছে ৯০ শতাংশ এবং ডেন-ফোর ধরনটি দেখা যাচ্ছে ১০ শতাংশ। কক্সবাজারে ওয়ান এবং থ্রি এর সংখ্যা বেশি।
অসময়ে ডেঙ্গু যে কারণে
ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার বংশবিস্তার হয় জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে, যেটি বর্ষায় বেশি দেখা যায়। প্রধানত মানুষের বাসাবাড়িতে আর নির্মাণাধীন ভবনে। বিশেষ করে ভবনের ছাদ নির্মাণের সময় যে পানি জমে থাকে, সেগুলোতে এডিস মশা ডিম পারে।
এবার বর্ষায় স্বাভাবিকের চেয়ে বৃষ্টি কম হয়েছে ৫৮ শতাংশ। যে বৃষ্টি হয়েছে, সেটিও বর্ষার মতো ছিল না। ঝিরঝিরে এই বৃষ্টিতে পানি কমেনি, যে কারণে এবার জুলাই-আগস্ট এডিসের বংশবিস্তারের জন্য আদর্শ পরিবেশ ছিল না।
তবে বর্ষা শেষে সেপ্টেম্বরে বৃষ্টি বাড়ার পর পর শুরু হয় ডেঙ্গুর আসল প্রকোপ। অক্টোবরে থেমে থেমে হওয়া বৃষ্টিতে আরও বেড়েছে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে টানা যে বৃষ্টি হচ্ছে, সেটি নতুন কোনো শঙ্কা তৈরি করে কি না, এমন প্রশ্নও তৈরি হয়েছে।
তবে অধ্যাপক কবিরুল বাশার এ ক্ষেত্রে অভয় দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘যে বৃষ্টি হয়েছে, সেখানে ঝোড়ো হাওয়া ছিল। এই হাওয়ায় মশার পাখা ভেঙে যায়। এতে তার মৃত্যু হয়। এখন মঙ্গলবারের আবহাওয়া কেমন থাকে, ঝড় কেমন হয়, সেদিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে। যদি বৃষ্টির এই ধারা অব্যাহত থাকে, তাহলে মশা কমতে পারে।’
তবে মশা কমলেই ডেঙ্গু কমবে, সেই পূর্বানুমানও করা যায় না।