বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

রক্ত নিতে বাধা ধর্মবিশ্বাস, জীবন-সংকট তরুণীর

  •    
  • ১৭ অক্টোবর, ২০২২ ১৮:৪৭

লিটন কস্তার পরিবার খ্রিষ্টধর্মের একটি অতি রক্ষণশীল ধারা ‘যিহোভাস উইটনেস’-এর অনুসারী। বাইবেলের জেনেসিস বা আদিপুস্তকের বিভিন্ন বিধান কঠোরভাবে অনুসরণ করে তারা। যিহোভাস উইটনেস অনুসারীরা মনে করে, অন্যের রক্ত দেহে প্রবেশ করানো ধর্মবিরুদ্ধ কাজ। এ জন্য থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত লিটন কস্তার মেয়ে রক্ত না নিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

মৌ কস্তার থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়ে ছয় বছর বয়সে। সেই থেকে চলছে নানান চিকিৎসা। তবে মৌ-এর শারীরিক অবস্থা দিনকে দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। কারণ একটাই, মৌ কারও রক্ত নিতে রাজি নন। পরিবারও এই সিদ্ধান্তে অনড়। প্রবল ধর্মবিশ্বাস মেনে চলতে গিয়ে মৌ কস্তার জীবন এখন সংকটাপন্ন।

২০০৫ সালে মৌ-এর থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়ে। এখন তিনি সাভারের একটি কলেজে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ালেখা করছেন।

মৌ-এর বাবা লিটন কস্তা নিউজবাংলাকে জানান, প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে প্রথমে জ্বর শুরু হয়। ১০৫-এর নিচে জ্বর না নামায় তাকে চিকিৎসকের কাছে নেয়া হয়। ওষুধ খেয়ে কিছুদিন ভালো থাকলেও আবার প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত হন মৌ।

লিটন কস্তা বলেন, ‘এরপর ওকে ঢাকার শিশু হাসপাতালে ভর্তি করার পর সেখানে থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়ে। এরপর ২০১০ সাল পর্যন্ত শিশু হাসপাতালেই চিকিৎসা চলেছে। পরে ডাক্তাররা বলেন, রক্ত দেয়া ছাড়া এটা কোনোভাবে রিকভারি করা যাবে না। আমরা সেটা মেনে নিইনি।’

লিটন কস্তার পরিবার খ্রিষ্টধর্মের একটি অতি রক্ষণশীল ধারা ‘যিহোভাস উইটনেস’-এর অনুসারী। বাইবেলের জেনেসিস বা আদিপুস্তকের বিভিন্ন বিধান কঠোরভাবে অনুসরণ করে তারা। বর্তমানে বিশ্বে যিহোভাস উইটনেস অনুসারী প্রায় ৮৭ লাখ। বাংলাদেশেও স্বল্প সংখ্যায় আছে তারা।

যিহোভাস উইটনেস অনুসারীরা মনে করে, জীবন বাঁচাতে অন্যের রক্ত দেহে প্রবেশ করানো ধর্মবিরুদ্ধ কাজ। সুঁই ফুটিয়ে রক্ত নেয়া আর মুখভর্তি রক্ত খাওয়ায় কোনো পার্থক্য নেই বলেও তারা মনে করে।

যিহোভাস উইটনেসের অনুসারীরা বিশ্বাস করে, অন্যের রক্ত গ্রহণ করলে মৃত্যুর পর চিরন্তন মুক্তি লাভের পথ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে তারা আদিপুস্তকের নবম অধ্যায়ের ৪ ও ৫ নম্বর পদের নির্দেশনা কঠোরভাবে অনুসরণ করে।

আদিপুস্তকের ৯:৪ নম্বর পদে বলা হয়েছে, ‘যে মাংসের মধ্যে সেই প্রাণীর প্রাণ (রক্ত) আছে সেই মাংস কখনও খাবে না।’

আর ৯:৫ নম্বর পদে বলা হয়েছে, ‘আমি তোমাদের জীবনের জন্য তোমাদের রক্ত দাবি করব। অর্থাৎ যদি কোনো জানোয়ার কোনো মানুষকে হত্যা করে তাহলে আমি তার প্রাণ দাবি করব এবং যদি কোনো মানুষ অন্য কোনো মানুষের প্রাণ নেয় আমি তারও প্রাণ দাবি করব।’

যিহোভাস উইটনেস অনুসারীদের দাবি, ঈশ্বরের কাছে রক্ত ও প্রাণ সমার্থক। আর তাই জীবনদাতা ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্যই তারা কখনও অন্যের রক্ত গ্রহণ করে না।

এই ধর্মবিশ্বাস থেকেই মৌ ও তার পরিবার মৃত্যু মেনে নিতে প্রস্তুত, কিন্তু থ্যালাসেমিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখতে কারও রক্ত গ্রহণ না করার বিষয়ে অনড়।

লিটন কস্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই রক্ত না নেয়ার ব্যাপারটা আমরা নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে কঠোরভাবে মানি। তবে অন্য খ্রিষ্টানরা এটা মানেন না।’

রক্ত পরিবর্তনের চিকিৎসা এড়াতে মেয়ের জন্য বিকল্প চিকিৎসাপদ্ধতি খুঁজেছেন লিটন কস্তা। তবে তা খুব একটা কাজে আসেনি।

লিটন বলেন, ‘শিশু হাসপাতাল থেকে চলে আসার পর এক আত্মীয়ের মাধ্যমে ইংল্যান্ডের একজন চিকিৎসক ডা. এন্ড্রুর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়। তিনি নীল কচ্ছপের (বিরল একটি প্রজাতি) দেহের ওপরের অংশ দিয়ে তৈরি করা হারবাল মেডিসিন পাঠান। সেটি নেয়ার পর মৌ-এর হিমোগ্লোবিন ২০১০ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত একটি স্থিতিশীল জায়গায় ছিল। তবে এরপর আবার তা কমে যেতে শুরু করে।’

চলতি বছরের গোড়ার দিকে সংকটাপন্ন মৌকে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হসপিটালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মনিরুল ইসলামের কাছে নিয়ে আসেন লিটন কস্তা। তবে এবারও রক্ত নিতে রাজি হননি মৌ ও তার পরিবার।

হেমাটোলজিস্ট ডা. মনিরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কয়েক মাস আগে মাত্র ২ দশমিক ৯ মাত্রার হিমোগ্লোবিন নিয়ে মৌ চিকিৎসার জন্য আসেন। ইমিডিয়েট রক্ত দেয়ার কথা বললে তারা চিন্তা করার জন্য কিছুটা সময় চান। এরপর অনেকক্ষণ হয়ে গেলেও না আসায় আমি রেজিস্টার থেকে নম্বর সংগ্রহ করে ফোন দিই। তাদের বলি, এই রোগী তো বাঁচাতে হবে। চলে গেলেন কেন?

‘এ সময় তারা বলেন, ভর্তির জন্য যথেষ্ট টাকা নিয়ে আসেননি। আর ধর্মীয় ইস্যুটার কথাও জানান। এরপর নিজে দায়িত্ব নিয়ে মৌকে ভর্তি করাই। তবে রক্ত নেয়ার ব্যাপারে কোনোভাবেই রাজি করানো যাচ্ছিল না। এমনকি মৌ লিখিতভাবে জানায়, ধর্মীয় নিষেধ অমান্য করে সে রক্ত নেবে না। এতে যা হওয়ার হবে।'

মৌ-এর সংকটজনক অবস্থার কথা জানিয়ে ঢাকা মেডিক্যালের বিএমটি ইউনিট ও হেমাটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘তার হার্ট ফেইল করে যাচ্ছিল। শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। পরে একটি ইনজেকশন পুশ করে কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থায় আনা হয়।

‘আমি ঢাকা মেডিক্যালের কার্ডিওলজি ডিপার্টমেন্টের হেড-এর চেম্বারে চলে যাই। তিনি রোগীর অবস্থা শুনে বলেন এত খারাপ অবস্থায় রোগীর দায়িত্ব নেয়া ঝুঁকিপূর্ণ। পরে স্যার রাজি হন। তিনি হার্ট ম্যানেজমেন্টটা করেন আর আমি বাকি চিকিৎসা।’

ডা. মনিরুল বলেন, ‘সাত দিন পর রোগীর রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ৬-এর কাছাকাছি পৌঁছালে সে বাসায় ফিরে যায়। ঠিক চার সপ্তাহ পর হিমোগ্লোবিন বেড়ে হয় ৯ দশমিক ২। রোগীর পরিবার মনে করছে, তাদের অনড় ধর্মবিশ্বাসের কারণেই হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়ছে।’

মৌ-এর চিকিৎসা এখন কীভাবে চলছে জানতে চাইলে ডা. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘এখন মুখে মেডিসিন চলছে। রোগীর অবস্থা স্থিতিশীল।’

তিনি জানান, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের রক্তে হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক মাত্রা প্রতি ডেসিলিটারে ১৩ দশমিক ৫ থেকে ১৭ দশমিক ৫ গ্রাম। নারীদের রক্তে তা ১২ থেকে ১৫ দশমিক ৫ গ্রাম।

মৌ ও তার পরিবারের সম্মতির ভিত্তিতেই তার চিকিৎসা ও ধর্মবিশ্বাসসংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করছে নিউজবাংলা।

বিষয়টি নিয়ে নিউজবাংলা কথা বলেছে ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের সমন্বয়ক ফাদার প্যাট্রিক সিমন গোমেজের সঙ্গে।

তিনি দাবি করেন খ্রিষ্টধর্মে চিকিৎসার প্রয়োজনে অন্যর রক্ত নেয়ায় বাধা নেই।

তিনি বলেন, ‘যিশু নিজে রক্ত দিয়ে মানুষের মুক্তি দিয়েছেন। তাই যখন প্রয়োজন, মানুষকে রক্ত দিয়ে জীবন বাঁচানো শান্তিরই অংশ। রক্ত দিলে তো আমার ক্ষতি হচ্ছে না, বরং কাউকে রক্ত দিলে আমি আমার জীবন কারও সঙ্গে শেয়ার করছি। এটা তো গভীর এক বিষয়।’

খ্রিষ্টানদের প্রধান দুই ধারা ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্ট কারও ক্ষেত্রেই রক্ত দেয়া বা নেয়ার ব্যাপারে বিধিনিষেধ নেই বলে তিনি জানান।

যিহোভাস উইটনেস অনুসারীরা যে কারণ দেখিয়ে রক্তদানের বিরোধী সেটি ‘একান্তই তাদের নিজস্ব বিশ্বাস’ বলে মন্তব্য করেন ফাদার প্যাট্রিক।

এ বিভাগের আরো খবর