নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার চাপিলা পাবনাপাড়া গ্রামে এক ধরনের চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষজন। গ্রামের অর্ধশতাধিক মানুষ আক্রান্ত হলেও বাড়ছে সংখ্যা। শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষ আক্রান্ত হলেও স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো তৎপরতা নেই বলে অভিযোগ। এতে আতঙ্ক ছড়িয়েছে পুরো গ্রামে।
এলাকাবাসীর দাবি, রোগ নির্ণয় ও প্রতিকারে দ্রুতই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল গ্রামে আসা দরকার। এ জন্য তারা সরকারের উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।
সরেজমিনে চাপিলা পাবনাপাড়া গ্রামে গিয়ে কথা হয় গৃহবধূ লিমা খাতুনের সঙ্গে। দেড় বছর আগে বিরল এক চর্মরোগে আক্রান্ত হন তিনি। মুখমণ্ডল, হাতসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে রোগটি। মাসের পর মাস বিভিন্ন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েও প্রতিকার পাননি তিনি।
তার আক্রান্ত হওয়ার কিছুদিন পরই শিশুসন্তানসহ পারিবারের পাঁচজন একই রোগে আক্রান্ত হন।
লিমা খাতুন বলেন, ‘মাথা থেকে পা পর্যন্ত রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে। দেড় বছর ধরে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে গিয়েছি। চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ, মেডিসিন বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়েছি। যতদিন ওষুধ খাই, ততদিন ভালো থাকি। ওষুধ না খেলে আবার বাড়ে, ভয়ংকরভাবে ছড়িয়ে পড়ে।’
তিনি বলেন, ‘আক্রান্ত স্থানে চুলকায়, জ্বালা করে, লাল হয়ে ফুলে কষ বের হয়, এতে অস্বস্তি লাগে। আমি, আমার দুই শিশুসন্তান, শ্বশুর-শাশুড়িসহ পাঁচজন আক্রান্ত হয়েছি। চিকিৎসক বলে দীর্ঘদিন ধরে ওষুধ খেতে হবে। কিন্তু ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে আমরা ঠিকমতো ওষুধও কিনে খেতে পারি না।’
এ ছাড়া ওষুধ খেলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে মাথাব্যথা, ঠিকমতো ঘুম না হওয়ার কথাও জানান তিনি।
লিমার মতো একই ধরনের চর্মরোগে আক্রান্ত সে গ্রামের ফরিদা খাতুন, হাজেরা বেগম, রিমা খাতুন, সুলতান হোসেন, মেহেদী হাসানসহ অর্ধশতাধিক নারী পুরুষ।
দুই পায়ের আঙুলে চর্মরোগে আক্রান্ত ফরিদা খাতুন বলেন, ‘আক্রান্ত স্থানে হঠাৎ ঘামাচির মতো বের হয়। তারপর চুলকানি শুরু হয়। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে সমস্যা। চর্মরোগ প্রতিরোধের ওষুধ সেবন করলে সাময়িক সুস্থ থাকি। কিন্তু বিভিন্ন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েও কারও স্থায়ী সমাধান মেলেনি।’
একই গ্রামের সুলতান হোসেন জানান, চাপিলা পাবনাপাড়ায় ১০০টি পরিবার বসবাস করেন। এই গ্রামের প্রায় ২৫ ভাগ মানুষই চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছে। গ্রামে কারও দুই বছর, কারও দেড় বছর বা এক বছর আগে থেকে এই রোগ দেখা দিয়েছে।
গ্রামের আরেক বাসিন্দা মেহেদী হাসান জানান, দিনরাত ২৪ ঘণ্টা শরীরের বিভিন্ন স্থানে চুলকায়। এমনকি অনেক সময় আক্রান্ত স্থানে চুলকানোর কারণে রক্ত বের হয়। ফুলে লাল হয়ে যায়। তিনিও গ্রামে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাঠানোর অনুরোধ জানান।
আক্রান্ত শিশু সুয়াইবা খাতুনের মা রাহেলা বেগম জানান, তার ছোট্ট শিশু চুলকাতে না পেরে চিৎকার করে। শিশু বিশেষজ্ঞ, চর্ম রোগ বিশেষজ্ঞ অনেক ডাক্তার দেখিয়েছেন তিনি। এখনও রোগ থেকে মুক্তি মেলেনি। শিশুসন্তান নিয়ে তিনি অনেক সমস্যায় আছেন বলে জানান।
গুরুদাসপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ওই গ্রামে চর্মরোগে আক্রান্তের খবর জানি। গ্রামটিতে দীর্ঘদিন পানিসংকট ছিল। যে কারণে পাট জাগ দেয়া পানিতেই তারা গোসল করেছেন, দৈনন্দিন কাজ করেছেন। পানি থেকেই তাদের এই সংক্রমণটা হয়েছে।
‘অনেকেই বলছে, এটা ভাইরাস সংক্রমণ। কিন্তু এটা ভাইরাস সংক্রমণ নয়। এটা এক ধরনের ছত্রাক। এই রোগের সঠিক চিকিৎসা করলে স্থায়ীভাবে নিরাময় সম্ভব। ওই গ্রামের দুজন আক্রান্ত ব্যক্তি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন।’
গ্রামটিতে একটা স্বাস্থ্য ক্যাম্প করে আক্রান্তদের দেখা হবে বলেও পরিকল্পনার কথা জানান ওই চিকিৎসক।
আক্রান্তদের পচা, নোংরা পানিতে কোনো কাজ না করা, গোসল না করা, এলার্জি হয় এমন খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকা এবং নিয়ম করে ওষুধ সেবনের পরামর্শও দেন তিনি।
নাটোরের সিভিল সার্জন রোজী আরা খাতুন বলেন, ‘যে চর্মরোগের কথা শুনছি তাতে যতটুকু জেনেছি পানি থেকেই এটি ছড়িয়েছে। পাট জাগ দেয়া পানি ব্যবহারের কারণে তাদের দুই আঙুলের মধ্যে ফাঙ্গাল ইনফেকশন হচ্ছে। পরে তাদের শরীরেও সেটি ছড়াচ্ছে। আমাদের চিকিৎসক যারা আছেন তারা চিকিৎসা দিচ্ছেন। আমাদের হেলথ অ্যাসিসট্যান্ট, ইন্সপেক্টর যারা আছেন তাদের মাঠপর্যায়ে পাঠাচ্ছি। আক্রান্তদের আরও সমস্যা আছে কি না তা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। আমাদের উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে পর্যাপ্ত পরিমাণ ওষুধ আছে। তাই আতঙ্কিত বা ভয়ের কিছু নেই।’
তবে সিভিল সার্জনের এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে একাধিক এলাকাবাসী দাবি করেন, ‘তারা কোনো সময় পাট চাষ করেননি। মাঠপর্যায়ে এখনো কোনো চিকিৎসকও যাননি।’