বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

জলাতঙ্ক বাড়ছে, শূন্যে নামানোর লক্ষ্য পূরণে সংশয়

  •    
  • ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১৮:৪৪

জলাতঙ্কে মারা যান ২৯ জন, পরের বছর তা বেড়ে হয় ৩৯ জনে। চলতি বছর ৯ মাসে এ সংখ্যাটি হয়েছে ৩১ জনে। এই হারে মৃত্যু হতে থাকলে তা আগের বছরের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। অথচ সরকারের লক্ষ্য আছে ২০৩০ সালের মধ্যে মৃত্যু শূন্যে নামানোর।

কয়েক বছর ধরেই জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকা নিতে আসা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। প্রধানত কুকুরের কামড়ের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা থাকলেও বিড়ালের আঁচড় বা কামড়ের সংখ্যাও কম নয়।

ঢাকার সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে টিকা নিতে আসা মানুষের সংখ্যা এখন বছরে ৮০ হাজার ছাড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এর মধ্যে এখনও সিংহভাগই আসছে কুকুরের কামড় খেয়ে। তবে এ সংখ্যাটি কমে আসছে। কিন্তু বিড়ালের আক্রমণের শিকার মানুষদের সংখ্যাটি বাড়ছে।

টিকা নিতে আসা মানুষের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি জলাতঙ্কে মৃত্যুও তিন বছর ধরে ঊর্ধ্বমুখী। এ কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে জলাতঙ্কে মৃত্যু শূন্যে নামানোর যে লক্ষ্য, সেটি পূরণ হবে কি না, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে সংশয়।

এই পরিস্থিতিতেও দুই মাস ধরে পথকুকুরের টিকাদান বন্ধ ছিল, অথচ বছরের এই সময়টায় কুকুরের আক্রমণ বেশি থাকে।

আবার কুকুরের টিকাদান কর্মসূচি থাকলেও ঘুরে বেড়ানো বিড়ালকে টিকা দেয়ার কর্মসূচি নেই। যারা ঘরে প্রাণীটি পালেন, তারা অবশ্য নিজ উদ্যোগে টিকা দিয়ে থাকেন বিভিন্ন সেন্টারে।

কুকুরের টিকাদান কর্মসূচিতে জড়িত একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিড়ালের টিকাদানে কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই। কারণ হিসেবে বলছেন, ৯৫ থেকে ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে কুকুরের আক্রমণেই রোগটা হয়ে থাক। তাই কুকুরকেই প্রধানত টিকাগুলো দেয়া হয়। আর বিড়াল ধরাও সহজ নয়।

জলাতঙ্ক প্রতিরোধ দিবসে সংক্রামক প্রতিরোধ হাসপাতালে টিকার লাইন

জলাতঙ্ক প্রতিরোধের ডাক নিয়ে বুধবার বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও জলাতঙ্ক প্রতিরোধ দিবস পালনের দিন মহাখালীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাাতালে টিকা নিতে আসা মানুষের সারি দেখা যায়।

টিকা নিতে আসা মো. তপনের বাসা মিরপুর ১৩ নম্বরে। আক্রান্ত হয়েছেন পথকুকুরের দ্বারা।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘রাস্তায় হাইটা যাইতেছি। হঠাৎ একটা কুকুর আইসা পায়ে কামড় দিল।’

কুকুরটাকে দেখে ক্ষিপ্ত মনে হয়েছিল কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কিছুই টের পাই নাই। এই রকম তো অনেক কুকুর প্রতিদিন এলাকায় ঘোরাফেরা করে। তাই জলাতঙ্কের টিকা নিতে আসছি।’

সাত বছর বয়সী রিয়ামনিকেও টিকা দিতে নিয়ে এসেছেন তার মা। তাকেও বুধবার বিকেল ৫টার দিকে আচমকা কুকুর কামড় দেয় বলে জানান মা রশিদা বেগম।

বিড়ালের আক্রমণের শিকার হওয়া ১৩ বছরের মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন মাসাররাত হোসেন। চার দিন আগের ঘটনায় এক দফা টিকা দিয়েছেন আগেও, এবার এসেছেন দ্বিতীয় ডোজ নিতে।

মারাসাত বলেন, ‘বিড়ালটি পোষা নয়, ঘরের মধ্যেই কোথা থেকে এসে ঘোরাঘুরি করছিল। হতে পারে আশপাশের। তারপর কামড় দেয় মেয়েকে।’

আক্রান্ত, বিড়ালের আক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছে

এই হাসপাতালের তথ্যমতে, ২০১১ সাল থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত ৬ লাখ ২১ হাজার ৬৪৭ জন জলাতঙ্কের টিকা নিয়েছেন।

এর মধ্যে ২০২০ সালে টিকা নেন ৬২ হাজার ২৯৩ জন। এর মধ্যে কুকুরের আক্রমণের কারণে ৪৫ হাজার ৪৪৭ জন এবং বিড়াল ও শিয়ালের আক্রমণের শিকার হন ১৬ হাজার ৮১৬ জন।

ওই বছরে জলাতঙ্কে মারা যান ২৯ জন, যারা আক্রমণের পরও টিকা নেনটি।

২০২১ সালে প্রাণীর আক্রমণ বৃদ্ধির বিষয়টি বোঝা যায় টিকার সংখ্যায়। সে বছর টিকা নেন ৭৪ হাজার ৬৬২ জন। এদের মধ্যে ৫২ হাজার ১২ জন কুকুরের কামড়ে এবং ২২ হাজার ৬৫০ জন বিড়াল বা শিয়াল দ্বারা আক্রান্ত হন।

ওই বছর জলাতঙ্কে মৃত্যু বেড়ে হয় ৩৯ জন।

চলতি বছরের ২৭ সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত টিকা নিয়েছেন ৬০ হাজার ৫০০ জন। বাকি তিন মাস এই হারে টিকা দেয়া হলে সংখ্যাটি বেড়ে ৮ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন হাসপাতালের সহকারী পরিচালক মিজানুর রহমান।

এখন পর্যন্ত যত মানুষ এসেছেন, তাদের মধ্যে ৩৭ হাজার ৫৬৭ জন কুকুরের এবং ২২ হাজার ৯৩৩ জন বিড়াল-শিয়াল দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন।

চলতি বছরের ৯ মাসে এখন পর্যন্ত জলাতঙ্কে মারা গেছেন ৩১ জন। একই হারে যদি পরের তিন মাসে মৃত্যু হয়, তাহলে তা আগের বছরের সংখ্যাটি ছাড়িয়ে যেতে পারে।

হাসপাতাল কর্মকর্তা মিজানুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, 'প্রাণীদের কামড় আগের থেকে বেড়েছে। কারণ মানুষ এবং প্রাণীর সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু সচেতনতা বাড়েনি।

‘এখন পর্যন্ত যারা মারা গেছেন, তাদের কেউ টিকা নেননি। আর এই টিকার কার্যকারিতা থাকে তিন মাস। তাই বুস্টার ডোজ নিতে হবে।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল ইউনিট-সিডিসির কর্মকর্তা এস এম গোলাম কায়সার বলেন, ‘গণমাধ্যমের কাছে অনুরোধ থাকবে আপনারা সচেতনতা বাড়াতে কাজ করুন। যে মানুষগুলো মারা যাচ্ছে, তারা কেউ টিকা নেয়নি। কিন্তু জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে টিকাদানের সুযোগ আছে। কেউ আক্রান্ত হলে যেন টিকা নেন।’

গত তিন বছরে জলাতঙ্কে মৃত্যু বাড়ার বিষয়টি তুলে ধরে ২০৩০ সালের মধ্যে তা শূন্যে নামানো সম্ভব হবে কি না, এমন প্রশ্নে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা আশা করছি সম্ভব। ২০২০ সালে যে মৃত্যু কম হয়েছিল, সেটি হয়েছিল ওই বছর করোনার কারণে মানুষ বাইরে বেশি না হওয়ায়। তার আগের বছরগুলোতে প্রতি বছর মৃত্যু ৪০ থেকে ৫০ জনের মধ্যে থাকত।’

২০১১ সালে বছরে ৮২ জন মানুষ জলাতঙ্কে মারা গিয়েছিলেন বলে সিডিসির তথ্যে উল্লেখ আছে।

দুই মাস কুকুরের টিকা বন্ধ

প্রাণীর আক্রমণ এবং জলাতঙ্কে মৃত্যু বাড়তে থাকলেও গত দুই মাসে পথকুকুরকে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকা দেয়া বন্ধ থাকার তথ্য জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে জানান, চলতি বছর প্রায় ৯০ হাজার কুকুরকে টিকা দেয়া হয়েছে। তবে গত দুই মাস এই কর্মসূচি বন্ধ ছিল।

কেন বন্ধ- এই প্রশ্নে সেই কর্মকর্তা বলেন, ‘২৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবসের প্রস্তুতির জন্য এই কর্মসূচি বন্ধ রাখা হয়। সামনে আবার কর্মসূচি শুরু হবে।’

রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল ইউনিট-সিডিসির কুকুর টিকাদান কর্মসূচির এমডিভির আওতায় পথকুকুরকে এই টিকা দেয়া হয়।

কুকুরকে দুই মাস টিকা দেয়া বন্ধ রাখার কারণ জানতে চাইলে এই বিভাগের কর্মকর্তা এস এম গোলাম কায়সার বলেন, ‘সরকারের অর্থবছর শেষ হয় জুনে। এরপর নতুন বরাদ্দ আসতে আসতে কিছু সময় লেগে যায়। সে সময় কুকুরকে টিকাদান বন্ধ রাখতে হয়।’

এই দুই মাস তাহলে ঝুঁকি তৈরি করে কি না- এমন প্রশ্নে সেই কর্মকর্তা বলেন, ‘বিষয়টি এমন না। আমাদের ক্যালেন্ডার ও হটস্পট অনুযায়ী টিকা দেয়া হয়। যেমন সামনে আমাদের টার্গেট আছে দেশের সব কুকুরকে তিন রাউন্ড টিকা দেব। আগে ঢাকায় দুই রাউন্ড এবং সারা দেশে এক রাউন্ড টিকা দেয়া হতো।’

বিড়ালকে টিকা না দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যারা এই প্রাণী পালেন, তারাই টিকা দিয়ে থাকেন। তবে ঘুরে বেড়ানো প্রাণীকে দেয়া হয় না। এগুলোকে ধরাও সহজ নয়। আর জলাতঙ্কের ক্ষেত্রে যেহেতু ৯৫ থেকে ৯৯ শতাংশ দায়ী কুকুর, তাই কুকুরকেই দেয়া হয়।

ভেট অ্যান্ড পেট কেয়ারের কনসালট্যান্ট রূপ কুমার বলেন, ‘জলাতঙ্ক সাধারণত কুকুর-শিয়ালের রোগ। আমাদের দেশে বা বিশ্বে জলাতঙ্কে আক্রান্ত প্রাণীর মধ্যে বিড়াল মাত্র ৪ শতাংশ। কুকুরের কামড় বা আঁচড় থেকে বিড়ালের শরীরে ভাইরাসটি ছড়ায়। তাই বিড়ালকেও দেয়া হয়।

‘তবে পোষ্য বিড়ালের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন দেয়ার হার বেশি, কারণ এদের মালিকরা হাসপাতাল বা ক্লিনিকে নেয়ার উদ্যোগ নেন।’

বেওয়ারিশ বিড়ালকে টিকার বাইরে রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এসব প্রাণীকে তো ধরা মুশকিল। তবে একেবারে দেয়া হয় না এমন না। আর বাজেটের অভাবও এটা সমস্যা।’

বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস উপলক্ষে আয়োজিত ভ্যাকসিনেশন প্রোগ্রামে বেওয়ারিশ বিড়ালকে জলাতঙ্কের টিকা দিচ্ছেন ডা. রূপ কুমার। ছবি: নিউজবাংলা

সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের সহকারী পরিচালক মিজানুর রহমান আরও একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি প্রাণীদের প্রতি সহনশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। বলেন, ‘অনেকেই কুকুর দেখলে তাদের আক্রমণ করে। এটা না করে আচরণ বদলাতে হবে। তাদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করতে হবে।

‘আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হলো ডেথ রিভিউ। অর্থাৎ কোন এলাকায় মৃত্যু হয়েছে, সেই এলাকায় সামাজিকভাবে বসে সব কুকুরকে টিকা নিশ্চিত করতে হবে। আর কেউ কামড়ের শিকার হলে তাকে অবশ্যই হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে টিকার জন্য।’

এ বিভাগের আরো খবর