অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধে যে অভিযান শুরু হয়েছে, সেটি নিষ্ফল হতে পারে বলে মনে করেন স্বাস্থ্য খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তারা বলছেন, বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাবের কারণে এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এর দায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের।
নীতিমালা অনুযায়ী, নিবন্ধন ছাড়াই স্বাস্থ্যসেবা খাতে বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান তাদের সেবা কার্যক্রম চালু করতে পারে। কার্যক্রম চলমান থাকা অবস্থায় ধাপে ধাপে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর থেকে ছাড়পত্র নিয়ে চূড়ান্তভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিবন্ধন নেয় তারা। এতে কেটে যায় কয়েক বছর।
এ কারণে দেশে অবৈধভাবে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে ওঠার সুযোগ পাচ্ছে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, প্রক্রিয়াগত ত্রুটির কারণে নিম্নমানের সেবা দিয়েও মুনাফা করছেন এমন অনেক প্রতিষ্ঠান। অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রোগী হয়রানির অভিযোগ ওঠে প্রতিনিয়ত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদারকির অভাব, লোকদেখানো অভিযান, নিজস্ব জনবল সংকটের সুযোগ নিচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।
তবে নিজেদের ব্যর্থতার দায় নিচ্ছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সরকারি এই সংস্থাটি বলছে, তারা এসব অবৈধ স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে আসছে। একই সঙ্গে নিবন্ধন পেতে যারা আবেদন করেছে, তাদের দ্রুত সময়ে নিবন্ধন দেওয়ার কাজ চলমান রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে নিবন্ধিত স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা ক্লিনিক রয়েছে ১০ হাজার ৯১৭টি। তবে বর্তমানে কতটি প্রতিষ্ঠান আবেদন করে নিবন্ধনের অপেক্ষায় রয়েছে, তা জানাতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা শুরুর দিকে যদি লক্ষ করি, বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে স্বাস্থ্যসেবার বিকাশ ঘটেছিল বিশৃঙ্খলভাবে। ফলে নিবন্ধন না নিয়েই আইনের বাইরে সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল এগুলো। প্রথম দিকে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম থাকলেও তা বাড়ছে প্রতিনিয়ত।’
বেসরকারি খাত অনেক বড় হয়ে যাওয়ায় বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নজরে এসেছে।
লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মানসম্মত করার কাজটি কখনই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ধারাবাহিকভাবে করেনি। এর আগে অনেকবার উদ্যোগ নিলেও ব্যর্থ হয়েছে তারা।’
এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠানে মানহীন চিকিৎসার কারণে মানুষের জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে বলে মন্তব্য করেন লেলিন চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘আমরা চাই এই খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসুক। এখন হাসপাতালগুলো বন্ধ করা হচ্ছে, এরপর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদারকিটা নিয়মিত চলতে থাকতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যদি এই যাত্রায় ব্যর্থ হয়, তবে এটাই হবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বড় ব্যর্থতা।’
বেসরকারি খাতে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে নিরবচ্ছিন্ন তদারকি প্রয়োজন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক ও সংঘবদ্ধ প্রভাব মোকাবিলা করতে হবে।’
অভিযানে বন্ধ করে দেয়া ক্লিনিকগুলো পরে আবারও খুলে দেয়া হয়। ফলে অধিদপ্তরের অভিযানের কোনো সুফল সেভাবে আসছে না। মালিকপক্ষের চাপের কারণে অধিদপ্তরকে অনেক সময় অসহায় ভূমিকায় দেখা যায় বলেও অভিযোগ রয়েছে।
কিন্তু যেখানে-সেখানে খুলে বসা ক্লিনিকগুলো বন্ধ করা যাচ্ছে না বলে যে অভিযোগ আছে, সেটা মানতে রাজি নন বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান ভুইয়া।
তিনি বলেন, ‘কী কারণে প্রতিবার খুলে দেয়া হয় আমার জানা নেই। তবে এবার আপনারা দেখতেই পারবেন কী করা হবে। এবার সেই সুযোগ থাকবে না। তবে যেসব কারণে ক্লিনিক বন্ধ করা হয়েছে, সেসব কারণ যদি ফুলফিল করে তাহলে খুলে দেওয়া হবে।’
যেসব ক্লিনিকে চিকিৎসক নেই, নার্স নেই, রোগী সেবা দেয়ার কোনো অবকাঠামো নেই, সেসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিলে আপত্তি নেই বলে জানিয়েছেন মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া।
তিনি বলেন, ‘অনেকে হাসপাতালের কার্যক্রম পরিচালনা করছে, কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নিবন্ধনের জন্য কোনো আবেদনই করেনি। তাই যে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে সেই অভিযানে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আমরাও চাই পথেঘাটে ক্লিনিক, দোকানের মধ্যে ক্লিনিক বন্ধ হোক।’
তিনি বলেন, যেসব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিবন্ধনের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আবেদন করেছে, তাদের দ্রুততম সময়ে নিবন্ধনের ব্যবস্থা করা হোক। কিছু হাসপাতাল মালিক আমাদের কাছে অভিযোগ জানিয়েছে অনলাইনে নিবন্ধন প্রক্রিয়া অনেক জটিল। এই সেবা সহজ করতে ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে অভিযানে নামে অধিদপ্তর। কিন্তু সোমবার এসে হোঁচট খেয়েছে চলমান এই অভিযান। এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠান বন্ধে এ দিন রাজধানীতে কোনো অভিযান পরিচালনা করা হয়নি বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক অধ্যাপক বেলাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘জেলা শহরে হয়তো হতে পারে। অভিযান চলমান প্রক্রিয়া।’
তবে রাজধানীর বাইরে অভিযানে কোনো তথ্য দিতে পারেনি হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার এই পরিচালক।
অভিযান কতদিন চলবে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমরা তো অভিযান বন্ধ করিনি। পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত চলমান থাকবে। তবে ক্রাশ প্রোগ্রাম যেটা ছিল, সেটা ক্রাশ প্রোগ্রাম হিসেবে চলবে না। এটা রুটিন প্রোগ্রাম হিসেবে চলমান থাকবে।’
২০২০ সালেও এমন অভিযানে নেমেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু মালিক পক্ষের চাপে অভিযান দেখেনি আলোর মুখ। ফলে অবৈধ অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়নি। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হলেও পরে তা আবার চালু করা হয়।
এবারও ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে কিনা জানতে চাওয়া হয় অধ্যাপক বেলাল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মালিকপক্ষের চাপে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অভিযান বন্ধ করেছে, এমন কোনো প্রমাণ আমার হাতে নেই।’
হাসপাতাল মালিকপক্ষের চাপে রোববার ডাকা অধিদপ্তরের সংবাদ সম্মেলনটিও স্থগিত করা হয়নি বলে দাবি করেন এই কর্মকর্তা। ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে তিনি বলেন, ‘অনিবার্য কারণবশত সংবাদ সম্মেলনটি বন্ধ করা হয়েছে। পরে যখন সংবাদ সম্মেলন করা হবে, তখন আপনাদের জানানো হবে।’
প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক অবৈধ স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে ওঠা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ব্যর্থতা কী না এমন প্রশ্নের জবাবে বেলাল হোসেন বলেন, ‘আমি এখানে আমাদের ব্যর্থতা দেখি না। আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। নতুন নতুন হাসপাতাল হবে নিবন্ধন নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা এটা স্বাভাবিক। করোনার কারণে গত দুই বছর হয়ত আমাদের তদারকি কিছুটা কম হয়েছে। বিপুল সংখ্যক বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বিপরীতে হাসপাতাল শাখার জনবল অনেক অপ্রতুল।’