চিকিৎসক সংকটে ভুগছে রাজধানীর মিরপুর মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান। ১০ তলা ভবনের ২০০ শয্যার হাসপাতালটি ২০২০ সালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক উদ্বোধন করলেও চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী সংকটের কারণে পূর্ণাঙ্গ সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
হাসপাতালটিতে শিশুদের জন্য ২০ শয্যার আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) রয়েছে। রয়েছে বড়দের জন্য পাঁচ শয্যার আইসিইউ। তবে জনবল সংকটের কারণে দুই বছরেও এই সেবা চালু করা সম্ভব হয়নি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখনও নিয়োগ দেয়া হয়নি কোনো নার্স। এতে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা কার্যক্রম। ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা সাধারণ মানুষকে।
হাসপাতালের তথ্য বলছে, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ একাডেমি স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের আওতায় পরিবার পরিকল্পনার অধীন একটি প্রতিষ্ঠান। ২০০৬ সালে সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে এটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০০৯ সালে অসম্পূর্ণভাবে শেষ হয় কিছু প্রশাসনিক ঝামেলার কারণে। পরে আট বছর তদন্ত শেষে আবার নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০১৯ সালের ৩০ জুন কাজ শেষ হয়। ওই বছরের ডিসেম্বরে হাসপাতালটি রোগীর সেবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
রোগীর সেবায় প্রসূতি, গাইনি, শিশু, প্রজনন স্বাস্থ্য বিভাগসহ ১৪টি বিভাগ থাকলেও অধিকাংশ বিভাগের কার্যক্রম দেড় বছরেও চালু করা সম্ভব হয়নি। ছবি: নিউজবাংলা
হাসপাতালে দুই ধরনের কর্মকাণ্ড চলে। প্রশিক্ষণ ও রোগীর সেবা। তবে চিকিৎসক কম থাকায় প্রশিক্ষণও চালু করা সম্ভব হয়নি।
রোগীর সেবায় প্রসূতি, গাইনি, শিশু, প্রজনন স্বাস্থ্য বিভাগ, নার্সিং বিভাগ, অ্যানেসথেসিয়া, বন্ধ্যাত্ব, জরুরি বিভাগ, রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং, ল্যাব মেডিসিন, রক্ত সঞ্চালন, ফার্মেসি, পুষ্টি, স্বাস্থ্য শিক্ষা, কৈশোরকালীন প্রজনন স্বাস্থ্য বিভাগ মিলে ১৪টি বিভাগ থাকলেও অধিকাংশ বিভাগের কার্যক্রম চালু করা সম্ভব হয়নি।
মিরপুরবাসীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ১৬১টি পদ সৃষ্টি হলেও মাত্র ৩৩ জনের জনবল দিয়ে চলছে হাসপাতাল। ৫৪টি চিকিৎসক পদের মধ্যে বর্তমানে আছেন ২৮ চিকিৎসক। ৬০টি নার্সের পদ থাকলেও দুই বছর এখনও কোনো নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়নি। নার্স না থাকায় এ কার্যক্রম চালাচ্ছেন বর্তমানে ১৮ জন এফডব্লিউভি ও ৭ মিডওয়াইফ দিয়ে। এই জনবল দিয়েই আউটডোর, ইনডোর, ইমারজেন্সি সেবা পরিচালিত হচ্ছে।
হাসপাতালের আইসিইউর যন্ত্রপাতিগুলো এখনও কাগজে মোড়ানো। ছবি: নিউজবাংলা
বুধবার দুপুরে হাসপাতাল সরেজমিনে ঘুরে এমন করুণ দশা চোখে পড়ে। জরুরি বিভাগে কোনো চিকিৎসক নেই। নেই কোনো নার্স বা স্বাস্থ্যকর্মী। ৩০ মিনিট অবস্থান করেও কারও দেখা পাওয়া যায়নি। হাসপাতালের আইসিইউগুলো তালাবন্দি করে রাখা। আইসিইউ সচল রাখার জন্য মাঝে মাঝে পরিষ্কার করে রাখা হয়।
হাসপাতালের পরিচালকের অনুমতি নিয়ে আইসিইউ রুমের ভেতরে গিয়ে দেখা যায় যন্ত্রপাতিগুলো এখনও কাগজে মোড়ানো।
হাসপাতালে এখন প্রতিদিন গড়ে ৩০০ রোগী সেবা নেন। দিনে ৭০ থেকে ৮০ প্রসূতির সিজারিয়ান ডেলিভারি হচ্ছে। একই সঙ্গে কমপক্ষে ৩০ জনের স্বাভাবিক ডেলিভারি হচ্ছে।
মিরপুর মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ হাসপাতালে দুই ধরনের কর্মকাণ্ড চলে। প্রশিক্ষণ ও রোগীর সেবা। তবে চিকিৎসক কম থাকায় প্রশিক্ষণও চালু করা সম্ভব হয়নি। ছবি: নিউজবাংলা
সব চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ দেয়া সম্ভব হলে সেবার মান আরও বাড়ানো সম্ভব বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির পরিচালক ডা. মোহা. শামছুল করিম। তিনি বলেন, ‘মা ও শিশুর সব চিকিৎসা এখানে দেওয়া হয় মাত্র পাঁচ টাকায়। এমনকি অপারেশন ফ্রি করা হয়। ওষুধ দেয়া হয় বিনা মূল্যে। তবে চিকিৎসক ও নার্স সংকটের কারণে মানুষের জন্য কাঙ্ক্ষিত সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। এ সংকট নিরসন হলে সেবার মান আরও বাড়বে।’
শিশুদের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘শিশুদের আইসিইউ অনেক প্রয়োজন। শিশুদের তো হাসপাতালে জায়গা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এখানে ২০ শয্যার আইসিইউ সুবিধা থাকলেও সেটি জনবল সংকটের কারণে ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। যেটুকু জনবল দিয়েছে, আমি সবটুকু ভালোভাবে ব্যবহার করছি।
সব পদে চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ দেয়া সম্ভব হলে সেবার মান আরও বাড়ানো সম্ভব বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির পরিচালক ডা. মোহা. শামছুল করিম। ছবি: নিউজবাংলা
‘করোনা নিয়ন্ত্রণে আসার পর অনেক বেশি মানুষ সেবা নিতে আসছে। যে জনবল রয়েছে এটা দিয়ে হয়তো আমি ৫০ মিটার দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছি। তবে আরও জনবল দিলে ১০০ মিটার দ্রুত হাঁটতে পারব। তবে জনবল আমার ওপর নির্ভর করে না। এটা মন্ত্রণালয় নিয়োগ দেয়। কিছু বিভাগের কাজ এখনও চালু করতে পারিনি। জনবল আসার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্যই এসব বিভাগ চালু হবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাশার খুরশীদ আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যখন চিকিৎসক নিয়োগ দেয়, তখন শুধু একটি হাসপাতালের জন্য নিয়োগ দেয় না। সারা দেশে যেসব হাসপাতালে চিকিৎসক সংকট, সবগুলোতেই নিয়োগের প্রস্তাব দেয়া হয়।
সম্প্রতি এখানে ৩৩৭ চিকিৎসক নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে নিয়োগ দেয়া হবে বলে জানান পরিচালক।
এ ছাড়া নার্স নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। আগামী ৩০ মে পর্যন্ত আবেদনের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে।
চিকিৎসক নিয়োগ দেয় পিএসসি। সংস্থাটি ৩৩৭ নার্স নিয়োগের সুপারিশ করেছে, তবে এই প্রক্রিয়া এখনও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আটকে আছে।