দেশে হাজারো নারী নিরাপদ মাতৃত্বের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অশিক্ষা, প্রশিক্ষণহীন ধাত্রী ও প্রলম্বিত চিকিৎসাহীনতার কারণে সন্তান প্রসবের সময় ফিস্টুলা রোগ বাড়ছে। নারীরা এই রোগ চেপে যাওয়ার কারণে চিকিৎসার বাইরে থেকে যাচ্ছে বড় একটি অংশ। ফলে তারা বিষণ্নতা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, দারিদ্র্য প্রভৃতি সমস্যায় পড়ছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে সার্জারি ছাড়াই ওষুধ দিয়ে এই রোগের চিকিৎসা সম্ভব। প্রসব ব্যথা ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে। এই রোগ নিয়ে এখনই সচেতন হতে হবে। রোগ হলে তা প্রকাশ করতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, বাংলাদেশে আনুমানিক ১ লাখ ২০ হাজার নারী প্রসবজনিত ফিস্টুলায় ভুগছেন। প্রতি এক হাজার বিবাহিত নারীর মধ্যে ১ দশমিক ৬৯ জন প্রসবজনিত ফিস্টুলায় আক্রান্ত। সারা বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ৮০০ নারী অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় অথবা সন্তান প্রসবের সময় মারা যান। শুধু বাংলাদেশে এ রকম মাতৃমৃত্যু হয় প্রতিদিন গড়ে ১৫টি। আর যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের মধ্যে অন্তত ২০ জন বা এরও বেশি মারাত্মক জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
আজ ২৩ মে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রসবজনিত ফিস্টুলা নির্মূল দিবস। ২০০৩ সালে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিকভাবে এই দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে ১০ বছর পর ২০১৩ সালে প্রথমবারের মতো দিবসটি পালিত হয়।
ইউএনএফপিএর কর্মসূচি ‘ক্যাম্পেইন টু এন্ড ফিস্টুলা’র আওতায় বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে দিবসটি পালিত হচ্ছে। ফিস্টুলা চিকিৎসার পাশাপাশি প্রসবজনিত এই জটিলতা নির্মূলে ডাক্তার, নার্স ও দক্ষ ধাত্রী প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সচেতনতামূলক কর্মসূচিও বাস্তবায়িত হচ্ছে।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইনি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নুসরাত আফরিন নীলা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অদক্ষ ধাত্রীর মাধ্যমে বাড়িতে জোর করে বা বাধাগ্রস্ত সন্তান প্রসবের কারণেই নারীকে ফিস্টুলার মতো জটিল স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগতে হয়। ফিস্টুলা আক্রান্ত নারীর অনবরত প্রস্রাব-পায়খানা ঝরতে থাকে। এ কারণে যোনিপথে চুলকানি হয়, ক্ষত তৈরি হয়। নারীর জন্য দুর্বিষহ জীবন শুরু হয়।’
তিনি জানান, প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে ফিস্টুলা চিকিৎসার মাধ্যমে পুরোপুরি ভালো হয়ে যায়। এমনকি সার্জারি করাও প্রয়োজন হয় না। বাংলাদেশে অনেক বেসরকারি সংস্থা এই রোগে বিনা মূল্যে সার্জারি করিয়ে থাকেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজসহ দেশের ১০টি হাসপাতালে এই রোগের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
প্রসবজনিত ফিস্টুলা মৃত সন্তান প্রসবে দায়ী
বাধাগ্রস্ত প্রসববেদনার ক্ষেত্রে সঠিক সময়ে জরুরি ও উন্নত চিকিৎসা না পেলে প্রসবকালীন বাধা থেকে নারীর জননাঙ্গের টিস্যুগুলোতে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে টিস্যুগুলো মারা যায় এবং একটি ছিদ্র তৈরি হয়। এমন অবস্থায় অধিকাংশ নারী মৃত সন্তান প্রসব করেন। এখনও যেসব নারী এ জটিলতায় আক্রান্ত হচ্ছেন, তারা সাধারণত দরিদ্র এবং চিকিৎসাসেবার আওতার বাইরে।
সন্তান প্রসবের সময় তাদের পাশে দক্ষ সেবাদানকারী ব্যক্তিরা থাকেন না। দেশে ৬০ শতাংশেরও বেশি প্রসব বাড়িতে হয়ে থাকে। নারীদের অবস্টেট্রিক ফিস্টুলা হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ বাল্যবিয়ে। অল্প বয়সে যেসব মেয়ের বিয়ে হয় এবং তারা গর্ভধারণ করে, তাদের শরীর সন্তান প্রসবের মতো চাপ সামলানোর উপযোগী থাকে না। ফলে ফিস্টুলার মতো অবর্ণনীয় যন্ত্রণার শিকার হয় তারা।
ফিস্টুলা দূর করতে করণীয়
প্রসবকালে সব নারীর পাশে দক্ষ সেবাদানকারীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং প্রসবজনিত জটিলতায় জরুরি সেবা দেওয়ার মাধ্যমে ফিস্টুলাকে প্রায় নির্মূল করা যেতে পারে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে দ্রুতগামী পরিবহনব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে অস্ত্রোপচারের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও কর্মীদের উপস্থিতি জরুরি। বাল্যবিয়ের অবসান ঘটিয়ে এবং মেয়েদের প্রথম গর্ভধারণের সময়টা পিছিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে ফিস্টুলার হার কমানো সম্ভব।