শিক্ষার্থীদের চিকিৎসাবিজ্ঞানে উন্নত শিক্ষা লাভের সুযোগ বাড়াতে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোর আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এ জন্য সব বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষকসংখ্যা, প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ, অবকাঠামো, পাঠদান ও চিকিৎসাসেবা সম্পর্কিত তথ্য চাওয়া হয়েছে। কিন্তু বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলো এতে সাড়া দিচ্ছে না।
বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। তাদের নির্দেশনার তোয়াক্কা করছে না প্রতিষ্ঠানগুলো।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে ৭২টি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের অধিকাংশই অনেকটা জোড়াতালি দিয়ে চলছে।
প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকসংখ্যা, প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ, অবকাঠামো, পাঠদান ও চিকিৎসাসেবা সম্পর্কিত তথ্য চাওয়া হলেও তারা তাতে সাড়া দিচ্ছে না। উল্টো ক্ষমতা ও তদবিরের মাধ্যমে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চালাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন সময় বেসকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শনে নানা অসংগতি পাওয়া গেছে। তবে সংকট কাটিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রকৃত চিত্র জানানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে অধিদপ্তর তথ্য চেয়ে একাধিকবার চিঠিও দেয়। কিন্তু গত বছরের ১৩ অক্টোবরের পর থেকে মাত্র ২৮টি প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকিগুলো পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেয়নি। যারা দিয়েছে তাদের অনেকের নাজুক পরিস্থিতি দেখা গেছে।
কলেজগুলোয় জোড়াতালির পাঠদানে মান নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। চিকিৎসক তৈরির নামে স্বাস্থ্য খাতকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও তারা রোগীদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে।
স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে সরকারি ও বেসরকারি মোট ১০৭টি মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য মোট আসনসংখ্যা ১০ হাজার ৬৯৭। তার মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ৪ হাজার ৩৫০ এবং ৭০ বেসরকারি কলেজে আসন রয়েছে ৬ হাজার ৩৪৭টি। কিন্তু হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া অধিকাংশেরই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, শিক্ষক, শিক্ষা উপকরণ, উন্নত মানের ল্যাবরেটরি, শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শেখানোর জন্য সুবিধা খুবই কম। ফলে এখান থেকে পাস করা চিকিৎসকদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, চিকিৎসাসেবার মান উন্নয়নে কাজ করছে সরকার। তবে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজেগুলো অসহযোগিতার কারণে এটি করা সম্ভব হচ্ছে না। অধিদপ্তর থেকে বেসরকারি মেডিক্যালের সার্বিক উন্নয়নে তাদের নজরদারি কার্যক্রম চলমান আছে। এ ধারাবহিকতায় একাধিক কলেজে পরিদর্শন প্রতিবেদন তৈরি করে সুপারিশসহ মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) অধিভুক্তি হালনাগাদ থাকা বাধ্যতামূলক হলেও ২০১২ সালের পর থেকে তা করা হয়নি। ৫৮ শতাংশ বেড অকুপেন্সি ঘাটতিসহ প্রায় সব বিভাগে শিক্ষক, ল্যাব, শ্রেণিকক্ষের সরঞ্জাম, লাইব্রেরির আসন এবং সার্ভিস রুলের ঘাটতি রয়েছে। ফলে ২০১৮-১৯ থেকে সর্বশেষ ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের জন্য অ্যাকাডেমিক অনুমোদন নবায়ন করার পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে সব শর্তাবলির দৃশ্যমান উন্নয়ন আবশ্যক বলে মন্তব্য করা হয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ছাত্রছাত্রী ভর্তির আসন বৃদ্ধির বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের উচ্চতর কমিটির কাছে পাঠানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ নিয়ে যে প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে, সেখানে ৮০ শতাংশ কলেজ বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ নীতিমালা পরিপূর্ণভাবে মানতে পারছে না। এর মধ্যে ৩০ শতাংশের মতো প্রায় শতভাগ ব্যর্থ হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এনায়েত হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি এই মুহূর্তে দেশের বাইরে আছি। দেশে ফিরে বিস্তারিত কথা বলতে পারব। বিষয়টি নিয়ে অধিদপ্তরের পরিচালক তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে পারবেন।’
অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. এ কে এম আহসান হাবিব নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসা শিক্ষা ও সেবার মান উন্নয়নে দফায় দফায় চিঠি দিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য জানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কয়েক বছরে সাতটি মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তি স্থগিত করা হয়েছে। কিন্তু কলেজগুলো বিভিন্ন সময় উচ্চ আদালতে রিট করে কার্যক্রম চালাচ্ছে। অধিদপ্তর অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশনা দিলেও বিভিন্ন সময় উচ্চপর্যায়ের তদবিরে কার্যত্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তবে অনেক কলেজ চিকিৎসা শিক্ষাদানে বেশ ভালো করছে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও চিকিৎসা আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক ডা. রশীদ ই মাহবুব নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দেশে আশির দশক থেকে শুরু করে প্রায় ৪০ বছর ধরে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ নিয়ে কথা হচ্ছে। কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য অধ্যাদেশ লাগে, যা আজ অবধি সম্ভব হয়নি। আইন না থাকায় কোনো রকমে একটি নীতিমালা করে পরিচালিত হচ্ছে। ফলে সরকারিভাবে অনুমোদন নিয়ে অধিকাংশই নামকা ওয়াস্তে পরিচালিত হচ্ছে।
‘প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম পরিদর্শনে বিএমডিসি, বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকার রয়েছে। তাদের কোনো সমন্বয় নেই। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ও বিএমডিসির লাইসেন্স ছাড়া প্রায় সবকিছু প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। শিক্ষক, অবকাঠামো, মান নিয়ন্ত্রণ কোনোটাই সঠিকভাবে হচ্ছে না। এতে করে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জন করলেও সবাই পেশা-জীবনে তা প্রয়োগ করতে পারছে না, দক্ষ হচ্ছে না। প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকা ছাড়া এটা সম্ভব নয়। এ জন্য আইন করে মান নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব দিতে হবে।’
বেসরকারি মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজে ১০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক থাকার বাধ্যবাধকতা রেখে গত বছরের ৩ মে এ-সংক্রান্ত আইনের খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় নতুন আইনের খসড়া অনুমোদনের জন্য গত ৩০ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ‘বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজ বিল-২০২২’ সংসদে তোলেন। বিলটি পরীক্ষা করে সংসদে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়।
ওই বিলে বলা হয়েছে, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ বা ডেন্টাল কলেজের প্রত্যেক বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত হবে ১:১০। কোনো বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষকের সংখ্যা সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুমোদিত পদের ২৫ শতাংশের বেশি রাখা যাবে না। বেসরকারি মেডিক্যাল বা ডেন্টাল কলেজে অন্তত ৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের জন্য মেট্রোপলিটন এলাকায় কমপক্ষে দুই একর এবং ডেন্টাল কলেজের জন্য এক একর জমি থাকতে হবে। অন্য এলাকায় এই জমির পরিমাণ চার একর ও দুই একর হতে হবে। এই জমি সংশ্লিষ্ট কলেজের নামে নিরঙ্কুশ, নিষ্কণ্টক, অখণ্ড ও দায়মুক্ত হতে হবে। মেডিক্যাল কলেজ বা ডেন্টাল কলেজ এবং এর অধীন পরিচালিত হাসপাতাল কোনোভাবেই ইজারা বা ভাড়া নেওয়া জমিতে বা ভবনে স্থাপন করা যাবে না।