লেখক ও শিক্ষক অ্যালেনা কাটজাপ, লস অ্যাঞ্জেলসের বাসিন্দা। ৩ দিনের বেশি সময় ধরে জ্বর ও কাশিতে শয্যাশায়ী থাকার পর তিনি বুঝতে পারেন, এর জন্য হয়তো করোনাভাইরাসই দায়ী। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। এর পরও তিনি খুব একটা চিন্তিত ছিলেন না, কারণ তার আক্রান্তের লক্ষণগুলো ছিল মৃদু। তার শ্বাসকষ্টজনিত কোনো সমস্যা হয়নি, এমনকি হাসপাতালেও যেতে হয়নি। তিনি কয়েক দিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে যান।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাটজাগ বলছিলেন, আমার মনে আছে। ঈশ্বর, আবার সুস্থ হতে পেরে খুব ভালো লাগছে। তারপর হটাৎ করে পরের দিনই আমি ধাক্কাটা খাই। বমি আসতে থাকে, পেটের পীড়ায় ভুগছিলাম আমি ও বিরক্তিকরভাবে স্মৃতিভ্রষ্টতায় আক্রান্ত হই।
মোটামুটি ৮ কোটি আমেরিকান, যারা এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের মধ্যে বেঁচে যাওয়া প্রতি চারজনের একজন ‘কগনিটিভ ইমপায়ারম্যান্ট’ সমস্যায় ভুগছেন। সাধারণত এ ধরনের সমস্যায় একজন ব্যক্তি নতুন কোনো কিছু শেখার ক্ষেত্রে, বোঝার ক্ষেত্রে, কোনো কিছু মনে করতে গেলেও সমস্যার সম্মুখীন হন। এই সমস্যাকেই বলা হচ্ছে ‘ব্রেইন ফগ’।
যদিও ‘ব্রেইন ফগ’ এখন পর্যন্ত মেডিক্যাল টার্ম হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যার অধ্যাপক এডওয়ার্ড শার্টার ‘ব্রেইন ফগের’ ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, ‘এটি মূলত বিভ্রান্তি তৈরি, শব্দ খুঁজে পেতে অসুবিধার সম্মুখীন হওয়া, স্বল্পমেয়াদি স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া, মাথা ঘোরানো এবং মনোনিবেশ করতে অক্ষমতা এসব কিছু বোঝানোর ক্ষেত্রে একটি প্রতীকী শব্দ হয়ে উঠছে।’
কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের থেকেও প্রায় তিনগুণ বেশি রোগী কোভিড-পরবর্তী ‘কগনিটিভ ইমপায়ারম্যান্ট’ সমস্যায় ভুগছেন।
মস্তিষ্কের স্ক্যানগুলোতে দেখা যাচ্ছে, কোভিডের মৃদু সংক্রমণেও মস্তিষ্কের অংশ সংকুচিত হতে পারে। যার ফলে প্রায় ১০ বছর বয়সের সমান শারীরিক পরিবর্তন হতে পারে।
মস্তিষ্ক সাধারণত সংকুচিত হতে শুরু করে যখন একজন ব্যক্তির বয়স ৩০ ছাড়িয়ে যায় এবং ৬০-এর পর তা সংকুচিত হওয়ার গতি বৃদ্ধি পায়। তবে মস্তিষ্কের সংকোচন, তার সব অংশে একই রকমভাবে হয় না। এখন দেখা যাচ্ছে, করোনাভাইরাসে মৃদু সংক্রমণে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে হুট করেই মস্তিষ্ক সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে।
যা বলছেন গবেষকরা
নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ফেইনবার্গ স্কুল অফ মেডিসিনের স্নায়ু বিশেষজ্ঞ আয়ুশ বাত্রা বলেন, কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হওয়ার পরে স্নায়ুতে স্থায়ী ইনজুরি হওয়ার জৈব ও জৈব রাসায়নিক প্রমাণ রয়েছে। রোগীরা তাদের উপসর্গের বিষয়টি জানাচ্ছে। এটি তাদের জীবনযাত্রার মান এবং দৈনন্দিন কাজকর্মকে প্রভাবিত করছে।
কোভিড-১৯ সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার আগে এবং পরে মানুষের মস্তিষ্কের পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করছিলেন যুক্তরাজ্যের একদল গবেষক। তারাও মৃদু সংক্রমণে স্নায়বিক ক্ষতির প্রমাণ পেয়েছেন।
৫১ থেকে ৮১ বছর বয়সী ৭৮৫ জন এই গবেষণা জরিপে অংশগ্রহণ করেছেন। মহামারি শুরুর আগে যাদের মস্তিষ্ক স্ক্যান করা হয়েছিল। ইউকে বায়োব্যাংক প্রকল্পের অংশ হিসেবে তিন বছর পর তাদের মস্তিষ্ককে পুনরায় স্ক্যান করা হয়েছিল। এদিকে মেডিক্যাল বোর্ডের রিপোর্টে বলা হয়েছে, স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে ৪০১ জন কোভিড-১৯-এ সংক্রমিত হয়েছিল। এর বেশির ভাগই হালকা সংক্রমণ, ৪০১ জনের মধ্যে মাত্র ১৫ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।
স্ক্যানের ফলাফলগুলো দেখায়, কোভিডে সংক্রমণের প্রায় সাড়ে চার মাস পরে আক্রান্ত ব্যক্তিরা গড়ে ০.২ থেকে ২ শতাংশ মস্তিষ্কের আকার হারিয়েছে। যেখানে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি প্রতিবছর গড়ে মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাস এলাকার ০.২ থেকে ০.৩ শতাংশ হারায়, যা স্মৃতির সঙ্গে যুক্ত।
এ ছাড়া গন্ধের সঙ্গে যুক্ত মস্তিষ্কের অঞ্চলে, সুস্থ লোকের তুলনায় কোভিড-১৯ আক্রান্তের ০.৭ শতাংশ বেশি টিস্যুর ক্ষতি হয়েছে।
বিভিন্ন ধরনের ‘কগনিটিভ টেস্ট’ যেমন মনোযোগ, ভিজ্যুয়াল স্ক্রীনিং ক্ষমতা এবং প্রক্রিয়াকরণের গতি পরিমাপ করা দুটি পরীক্ষায় তারা ৮ থেকে ১২ শতাংশ বেশি সময় নিয়েছে। তবে প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে খুব একটা প্রভাব পড়েনি।
এদিকে ইউনিভার্সিটি অফ প্যারিসের ল্যারিবোইসিয়া হাসপাতালের স্নায়ু বিশেষজ্ঞ জ্যাক হুগন বলেন, ‘আমরা ঠিক জানি না মস্তিষ্কে কী ঘটছে, তবে এটি একটি ঝুঁকি। আমাদের আগামী বছরেও কোভিড-১৯ আক্রান্তদের সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।’
শুধু মস্তিষ্কের ক্ষতিই নয়, কোভিড-১৯ ছয় মাস পর্যন্ত রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি বাড়ায়, যা স্ট্রোকের কারণ হতে পারে। এ ছাড়া ইউএস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ বলছে, ফুসফুসের বাইরে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে ফেলতেও ভূমিকা রাখতে পারে।