২০১৯ সালে ডেঙ্গু মহামারির সময়ে এডিস মশার যে ঘনত্ব ছিল, এ বছর ঘনত্ব তার চেয়েও বেশি। রাজধানীর মগবাজার, নিউ ইস্কাটন, বাসাবো, গোড়ান, এলিফ্যান্ট রোড ও সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় এডিস মশার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি।
এ ছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকা থেকে দক্ষিণ সিটিতে এডিস মশার ঘনত্ব বেশি।
মশার ঘনত্ব ও বিস্তারসংক্রান্ত এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। জরিপটি পরিচালনা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি।
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ বছর ডেঙ্গু মহামারির আশঙ্কা করছে না, কারণ এডিস মশার ঘনত্ব বাড়লেও রাজধানীতে এডিসবাহী মশার বিস্তৃতি কমেছে বলে তারা মনে করে।
চলতি বছর জানুয়ারিতে ৩২ জনের দেহে ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে বছর শুরু হয়েছিল। জুনে এটা ১৭২ জনে ওঠে। জুলাই মাসে সেটিই হয়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ২৮৬ জনে। তাতে সব মিলিয়ে এ বছরের প্রথম সাত মাসে ডেঙ্গুতে মোট শনাক্ত দাঁড়ায় ২ হাজার ৬৫৮ জন। তবে আগস্টের ২২ দিনেই শনাক্ত হয়েছে ৫ হাজার ৩৮৩ জন। মারা গেছে ৩৬ জন।
জুলাই মাসের ২৯ তারিখ থেকে আগস্ট মাসের ৭ তারিখ পর্যন্ত ১০ দিনব্যাপী এডিস মশাসংক্রান্ত জরিপটি করা হয়। অধিদপ্তরের ২০টি টিম ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯৮টি এলাকার ১০০টি স্থানে এই জরিপ পরিচালনা করে।
এই জরিপ মূলত ব্রুটো ইনডেক্স ও হাউস ইনডেক্সের মাধ্যমে করা হয়। ব্রুটো ইনডেক্সে এক শ প্রজনন উৎসের মধ্যে ২০টি বা তার বেশিতে যদি এডিস মশার লার্ভা ও পূর্ণবয়স্ক মশা পাওয়া যায়, তাহলে সেটাকে ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি বলা যায়। সেখান থেকে এডিস মশাজনিত রোগ হতে পারে। লার্ভা ও মশা ১০ থেকে ২০-এর মধ্যে থাকলে সেখানে মশার মোটামুটি উপস্থিতি আছে বলে ধরে নেয়া যায়। একইভাবে হাউস ইনডেক্সে মূলত আক্রান্ত বাড়ির সংখ্যাকে ১০০ দিয়ে গুণ করে ওই এলাকার মোট বাড়ি দিয়ে ভাগ করা হয়। সে ক্ষেত্রে তা ১০-এর বেশি হলে মশার ঘনত্ব বেশি হবে।
কী উঠে এসেছে জরিপে
জরিপে দেখা যায়, ৪১টি এলাকার মধ্যে ২০১৯ সালে উত্তরের ২৪টি এলাকায় মশার ঘনত্ব ব্রুটো ইনডেক্সে ২০-এর উপরে ছিল, যা এবার ২৬টি এলাকায় পাওয়া গেছে। এ সময় হাউস ইনডেক্সে ২০১৯ সালে ৩০টি এলাকা থাকলেও এবার তা ৩৯টি এলাকায় উন্নীত হয়েছে। এই দুটি ইনডেক্স ২০২০ সালে যথারীতি ৯টি ও ২৯টি এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রে ৫৯ এলাকার মধ্যে ২০১৯ সালে ব্রুটো ইনডেক্সে ৩৭টিতে মশার ঘনত্ব বেশি ছিল, যা এবার ৩০টি এলাকায় রয়েছে। তবে হাউস ইনডেক্সে ২০১৯ সালে ৪৭টি এলাকা থাকলেও এবার তা ৪৯টিতে উন্নীত হয়েছে। এই দুই ইনডেক্সে ২০২০ সালে যথাক্রমে ১৭টি ও ৩৭টি এলাকা ছিল।
যেসব এলাকায় এডিস মশা সবচেয়ে বেশি
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপে উত্তর ও দক্ষিণের যথাক্রমে পাঁচটি করে ওয়ার্ডে সর্বোচ্চ এডিস মশার ঘনত্বের কথা বলা হয়।
ঢাকা উত্তরের পাঁচটি ওয়ার্ড হলো: মগবাজার, নিউ ইস্কাটনে মশার ঘনত্ব শতকরা ৫৬.৭ ভাগ, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, নিকুঞ্জে ৪৮.৪ ভাগ, কল্যাণপুর, দারুস সালামে ৪৬.৭ ভাগ, মিরপুর-১০, কাজীপাড়ায় ৪৩.৩ ভাগ, মহাখালী, নিকেতনে ৪০ ভাগ।
ঢাকা দক্ষিণের বাসাবো, গোড়ানে ৭৩.৩ ভাগ, এলিফ্যান্ট রোড, সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় ৬৬.৭ ভাগ, আর কে মিশন রোড, টিকাটুলীতে ৫০ ভাগ, বনশ্রীতে ৪০ ভাগ, মিন্টো রোড, বেইলি রোডে ৪০ ভাগ এডিস মশার ঘনত্ব পাওয়া গেছে।
ব্রুটো ইনডেক্স অনুযায়ী এটি ২০-এর নিচে থাকলে স্বাভাবিক বলা হয়।
তবে দুই সিটির দুটি ওয়ার্ডে ঘনত্ব ব্রুটো ইনডেক্স শূন্য পাওয়া গেছে। এটি দুটি এলাকা হলো উত্তরে আবতাফনগর ও মেরুল বাড্ডা এবং দক্ষিণে বংশাল।
মশার ঘনত্ব বেশি কোথায়
জরিপে মেঝেতে জমানো পানিতে সর্বোচ্চ শতকরা ১৮ দশমিক ৫ ভাগ, প্লাস্টিক ড্রামে ১২ দশমিক ১ ভাগ, প্লাস্টিক বালতিতে শূন্য ৯ দশমিক ৪ ভাগ, ফুলের টব এবং ট্রেতে শূন্য ৭ দশমিক ৫ ভাগ, পরিত্যক্ত গড়ির টায়ারে ৬ দশমিক ৯ ভাগ এবং রঙের কৌটায় ৩ দশমিক ২ ভাগ এডিস মশার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
জরিপে এডিস মশার পজিটিভ প্রজনন স্থানের প্রাপ্যতার ভিত্তিতে পজিটিভ বাড়ির শতকরা হার বহুতল ভবনে ৪৪ দশমিক ২ ভাগ, একক ভবনসমূহে ২৪ দশমিক ৫ ভাগ, নির্মাণাধীন ভবনে ১৯ দশমিক ১ ভাগ, বস্তি এলাকায় ৯ দশমিক ৭ ভাগ এবং পরিত্যক্ত জমিসমূহে ২ দশমিক ৬ ভাগ।
জরিপে এডিস মশার পজিটিভ কনটেইনারের (পানিতে লার্ভা ও পিউপার উপস্থিতি) শতকরা হার (পজিটিভ প্রজনন স্থান অনুযায়ী) বহুতল ভবনে ৪৪.২ ভাগ, একক ভবনসমূহে ২৫ ভাগ, নির্মাণাধীন ভবনে ১৮ দশমিক ২ ভাগ, বস্তি এলাকায় ৯ দশমিক ৭ ভাগ ও খালি জমিসমূহে ৩ ভাগ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দায় নাগরিকদেরও
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই জরিপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখন আমরা মশা নিয়ে যে রেজাল্ট পাচ্ছি, তা এ মাসের শুরুর দিকের। হয়তো এখন একটু কমতে পারে, তবে ঘনত্ব প্রায় একই রকম থাকবে। যে জায়গাগুলোতে ঘনত্ব ২০-এর ওপরে আছে, সেগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।’
মশার ওষুধে কোনো ঘাটতি আছে কি না, জানতে চাইলে এই কীটতত্ত্ববিদ বলেন, ‘এখানে সমস্যা ওষুধের না। কীটনাশকের খুব একটা ভূমিকা নেই। এখানে মানুষের সম্পৃক্ততা রয়েছে। যে যার বাড়িতে যদি এটা ঠিক রাখে যে, এডিস মশা জন্মাবে না, তাহলে এটা অনেক কমে যেত।’
তিনি বলেন, কিউলেক্স ও এডিস মশার মধ্যে পার্থ্যক্য আছে। এডিস বাসাবাড়ি বা নির্মাণাধীন ভবনে জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে জন্ম নেয়। মেঝেতে জমে থাকা পানিতে এটি বেশি পাওয়া গেছে। সিটি করপোরেশনের যেমন এডিস মশা দমনের দায় আছে, তেমনই বাসাবাড়িতে যেন মশা না হয়, সেটির দায় নাগরিকদের নিতে হবে।
তবে তিনি বলেন, এ বছর ডেঙ্গু অনেক বেশি, যা পুরোপুরি রিপোর্ট হচ্ছে না। রোগী ২০১৯ সালের মতো না হলেও কাছাকাছি বলে ধারণা করেন তিনি।
কী বলছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. আফসানা আলমগীর খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা সিটি করপোরেশনকে এরই মধ্যে বার্তা দিয়েছি। এমনকি কোন কোন এলাকায় এডিস মশার ঘনত্ব বেশি, সেটাও উল্লেখ করে দেখিয়ে দিয়েছি।’
২০১৯ সাল থেকে ঢাকায় এবার এডিস মশার ঘনত্ব বেশি দেখা যাচ্ছে। এবার ডেঙ্গু ২০১৯ সালের চেয়ে ভয়াবহ হবে কি না, জানতে চাইলে আফসানা আলমগীর বলেন, ‘এবার ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নেবে না। আপনি যদি আমাদের কেস স্টাডি দেখেন, ২০১৯ সালে ডেঙ্গুর মহামারি ছিল। ওই বছর এক মাসে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছিল ৫২ হাজারের বেশি। সেবার এই এডিস মশার ঘনত্ব অনেক এলাকাজুড়ে ছিল।’
এবার এলাকা কমলেও মশার ঘনত্ব বেশি, এটি স্বীকার করে এই কর্মকর্তা বলেন, ২০২১ সালে এলাকার সংখ্যা কমে এসেছে। তবে যে জায়গায় এডিস মশা আছে, সেখানে মশার ঘনত্ব অনেক বেশি। এ কারণে এডিস মশার সার্বিক ঘনত্ব বেশি দেখা যাচ্ছে। আস্তে আস্তে জায়গাগুলো কমে আসছে।
উত্তর সিটি থেকে দক্ষিণ সিটিতে এডিস মশার ঘনত্ব বেশি কেন, জানতে চাইলে আফসানা আলমগীর বলেন, ‘ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে নগরায়ণ পরিকল্পনা অনুযায়ী করা। ঢাকা দক্ষিণের নগরায়ণ পরিকল্পিত নয়। অফিস-আদলত, কলোনি, কারখানা, আড়ত- এগুলো পুরান ঢাকায় বেশি।
‘এ ছাড়া উত্তরের চেয়ে দক্ষিণ সিটির জনসংখ্যা দ্বিগুণ। সে কারণে দক্ষিণে এডিস মশার বিস্তর বেশি।’
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাশার খুরশীদ আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ডেঙ্গু নিধনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে গত মার্চ মাসে সিটি করপোরেশনগুলোতে চিঠি দেয়া হয়েছে। তাতে মশার উৎপত্তিস্থলগুলো ধ্বংস করে দিতে বলা হয়েছিল। তবে তাতে কোনো কাজ হয়নি।
ডেঙ্গু যেন না হয়, তার ব্যবস্থা নিতে নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘ডেঙ্গু হলে নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য বিভাগ সেবা দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করবে। তবে ডেঙ্গু যেন না হয়, সে জন্য সিটি করপোরেশনকে কাজ করতে হবে।’