অন্তঃসত্ত্বা মায়ের রক্তে জটিলতার কারণে ঝুঁকিতে গর্ভস্থ শিশু। তার প্রাণ বাঁচাতে গর্ভের ভেতরেই বদলানো হয়েছে রক্ত। পজিটিভ গ্রুপের রক্ত বদলে দেয়া হয়েছে নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিরল ঘটনাটি ঘটেছে ভারতের কলকাতায়।
জানা গেছে, গর্ভে থাকা ২৪ সপ্তাহ বয়সী ভ্রূণটির হাত, পা, পেট ফুলে যাচ্ছে, ত্বকের নিচে পানি জমছে। এ অবস্থায় নির্দিষ্ট সময়ের আগে তাকে পৃথিবীর আলো দেখানো হলেও বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
একমাত্র সমাধান হিসেবে মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থাতেই ভ্রূণের রক্ত বদলের সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসকরা।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় বিরল এই অসুখের নাম হবু মায়ের ক্ষেত্রে ‘রিসার্স আইসো ইমিউনাইজেশন’ ও ভ্রূণের ক্ষেত্রে ‘হাইড্রপ ফেটালিস’।
গর্ভস্থ ভ্রূণের রক্ত বদলের জটিল এই চিকিৎসা শুরু হয়েছে কলকাতার অ্যাপোলো হাসপাতালে। এ জন্য পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরের অনুমতি নিতে হয়েছে এই চিকিৎসকদের। ভারতের পূর্বাঞ্চলে এ ধরনের চিকিৎসার ঘটনা এটাই প্রথম।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, বর্ধমানের বাসিন্দা রিমা চাকলাদার ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় স্বাস্থ্যগত কিছু জটিলতার কারণে সম্প্রতি অ্যাপোলোতে চিকিৎসকদের শরণাপণ্ন হন। আল্ট্রাসনোগ্রাফি পরীক্ষায় তার গর্ভস্থ শিশুর শরীরে পানি জমার বিষয়টি ধরা পড়ে।
হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. কাঞ্চন মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘রোগটি রক্তের। শিশুটির মায়ের রক্তের গ্রুপ এ নেগেটিভ। বাবার রক্ত বি পজিটিভ। এ ক্ষেত্রে দম্পতির সন্তানের রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ বা পজিটিভ দুই-ই হতে পারে।
‘এ রকম ঘটনায় মায়ের গর্ভজাত প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রে সাধারণত কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু প্রথম সন্তানের রক্তের গ্রুপ পজিটিভ হলে দ্বিতীয় সন্তানের ক্ষেত্রে গুরুতর সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমনটা হয়েছে রিমার ক্ষেত্রে।’
ডা. কাঞ্চন মুখোপাধ্যায় আরও বলেন, ‘প্রথম বাচ্চার রক্তের গ্রুপ ছিল পজিটিভ। এদিকে মায়ের রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ। প্রথম সন্তান জন্ম নেয়ার পরেও তার মাধ্যমে কিছু পজিটিভ ব্লাড সেল মায়ের দেহে থেকে গিয়েছিল; নেগেটিভ গ্রুপের রক্তের দেহে রোগ প্রতিরোধক্ষমতার কাছে যা ক্ষতিকর বা শত্রু প্রতিপন্ন।
‘তাই পজিটিভ ব্লাড সেলগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে মায়ের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়।
‘এরপর যখন তিনি দ্বিতীয়বার গর্ভধারণ করলেন, দেখা গেল দ্বিতীয় শিশুটিও পজিটিভ ব্লাড গ্রুপের হতে যাচ্ছে। ভ্রূণ অবস্থায় তার রক্তের গ্রুপ পজিটিভ হওয়ায় মায়ের অ্যান্টিবডি গর্ভস্থ শিশুর পজিটিভ ব্লাড সেলকেও শত্রু ভেবে মারতে শুরু করে।
‘এরই ধারাবাহিকতায় মানবশিশুতে রূপ নিতে থাকা অবস্থায় গর্ভস্থ ভ্রূণটির রক্ত পানি হয়ে শরীরে জমতে শুরু করে।’
রিমার চিকিৎসায় গঠন করা হয়েছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল। ওই দলে রয়েছেন ডা. কাঞ্চন মুখোপাধ্যায়, ডা. সুমনা হক, ডা. সিতারামা মূর্তি পাল, ডা. শ্যামাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় ও ডা. মল্লিনাথ মুখোপাধ্যায়।
গর্ভস্থ ভ্রূণের রক্ত দেয়া বা পরিবর্তনের পদ্ধতিটি খুবই জটিল।
চিকিৎসক সীতারামা মূর্তির কথায়, ‘মায়ের পেটে যে পদ্ধতিতে রক্ত দেয়া হচ্ছে, তার নাম ইন্ট্রা-ইউটেরিয়ান ব্লাড ট্রান্সফিউশন। প্রথমে মায়ের পেটের আলট্রাসনোগ্রাফি করা হয়। এরপর বাচ্চার নাড়ি যেখানে মায়ের শরীরের সঙ্গে জুড়েছে, সেখানে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় কৃত্রিমভাবে রক্ত দেয়া হয়।’
ওই চিকিৎসক আরো জানান, ‘অন্তঃসত্ত্বা মা ও শিশুটির পেটের অংশে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ চলছে। সপ্তাহে দুবার ১৫ থেকে ২০ মিলিলিটার করে রক্ত দিতে হচ্ছে। রক্ত দেয়ার আগে রেডিয়েশনের মাধ্যমে তা পরিশুদ্ধ করে নেয়া হয়, যেন তাতে কোনো জীবাণু বা অ্যান্টিবডি না থাকে।’
চিকিৎসক মল্লিনাথের মতে, শিশু প্রসবের উপযুক্ত না হওয়া পর্যন্ত এই পদ্ধতিতে তাকে রক্ত দেয়া হবে। সন্তানের জন্মের পরও তাকে বেশ কয়েকবার রক্ত দিতে হতে পারে।
ডা. শ্যামাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘প্রত্যেক মায়ের প্রথম গর্ভধারণের শুরুতেই অনাগত সন্তানের রক্তের গ্রুপ জেনে নেয়া উচিত এবং প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মেনে চলা উচিত।
প্রথম গর্ভধারণের সময় মায়ের অ্যান্টি-ডি ইনজেকশন দিলে এই সমস্যা এড়ানো সম্ভব।