চলমান করোনাভাইরাস মহামারিতে ব্যয় কমানোর জন্য সব মন্ত্রণালয়ের অর্থ ব্যয়ে লাগাম টানতে বলা হয়। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতের খরচের হাত খুলে দেয় সরকার। তবে বরাবরের মতোই করোনার এসময় অর্থ ব্যয়ের সে সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে স্বাস্থ্য খাত।
দক্ষতা ও সক্ষমতার অভাবে প্রায় সোয়া ৫ হাজার কোটি টাকা খরচ করা যায়নি এ খাতে। অথচ করোনাভাইরাসের সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যুর সময় উন্নত সেবার জন্য সবচেয়ে বেশি কাজ ও অর্থ ব্যয়ের কথা ছিল স্বাস্থ্য খাতের।
টাকা পেয়েও সেটি খরচ করতে না পারায় এ খাতের অদক্ষতা, দুর্নীতিকে দায়ী করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতে স্বাস্থ্য খাতের অক্ষমতার চিত্রই ফুটে উঠে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, ২০২০-২১ অর্থ বছরে স্বাস্থ্য খাতের দুটি বিভাগের মোট বরাদ্দ ছিল ১৩ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে মধ্যে স্বাস্থ্য সেবা ১১ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা পেলেও পুরো সময়ে (জুলাই-জুন) এই বিভাগ খরচ করতে পেরেছে ৬ হাজার ৯৩৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা, ৫৮ শতাংশের কম।
অপর দিকে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ ১ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা পেয়ে খরচ করেছে ১ হাজার ৫৭৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকা।
এ দুটি বিভাগ সম্মিলিতভাবে খরচ করতে পেরেছে ৮ হাজার ৫১৩ কোটি টাকা। বরাদ্দ বাস্তবায়নের হার ৬১ দশমিক ৪০ শতাংশ। ফেরত গেছে ৫ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা। অথচ দুই বিভাগ মিলে উন্নয়ন বাজেটের ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ পেয়েছিল।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন অনুবিভাগ) মো. সাইদুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গত বছর আমাদের নানা সমস্যা ছিল, তাই এডিপি বাস্তবায়ন কম হয়েছে, খরচ কম হয়েছে। এ বছর আমরা চেষ্টা করছি শুরু থেকেই, জুলাই থেকেই কীভাবে বাস্তবায়ন ভালো করা যায়।’
টাকা অব্যয়িত থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে টাকা খরচ আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল, যেমন টিকা কেনার ক্ষেত্রে। আমরা এখন যেভাবে খরচ করতে পেরেছি, গত মাসে অবস্থা সে রকম ছিল না। যেসব জায়গায় আগে ব্যয় হয়নি, এখন সেসব জায়গায় কাজ করা হচ্ছে। যেন সব জায়গায় সঠিকভাবে ব্যয় করা যায়, সে চেষ্টা করা হচ্ছে। করোনার সরঞ্জাম ও টিকা কেনার প্রকল্পগুলোও মনিটরিং হচ্ছে।’
স্বাস্থ্য খাতের দুটি বিভাগের অধীনে ৬৮টি প্রকল্প চলছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার এখন পর্যন্ত দুটি বড় প্রকল্প অনুমোদন করেছে, যার একটিতে অর্থ দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক, অন্যটিতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক।
গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা শনাক্তের পর তড়িঘড়ি করে দুটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। কিন্তু নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় গত অর্থ বছরে দুটি প্রকল্পে আশানুরূপ টাকা খরচ হয়নি।
অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনা মহামারিতে ভেঙে পড়েছে স্বাস্থ্য খাত। এই সময়ে চিকিৎসার অপ্রতুলতা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা সরঞ্জামের অভাবে হাসপাতালগুলো ধুঁকছে। তখন বাজেটে স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কিনতে যে পরিমাণ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, সেটি খরচ করতে পারেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এটি মেনে নেয়া যায় না।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতের ব্যবস্থাপনার যে ঘাটতি, করোনা সবার চোখে সেটি আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এ খাতে উন্নয়ন প্রকল্পে যা বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে তার বেশিরভাগ তো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করে। এরা যদি বলে, যে কাজটা আগামী বছরের জন্য এডিপি এবং অপারেটিং বাজেটের মাধ্যমে দেয়া হচ্ছে, সেটা আমরা করতে পারব না।
‘কিন্তু তারা না করবে না। তবুও তারা তা ঠিক মতো করতে পারছে কি না, তা তো টাকা ব্যবহারের মধ্যেই দেখাই যাচ্ছে। এমনকি যেটা ব্যবহার হচ্ছে সেখানেও তো দুর্নীতি অপচয় এগুলোর অভিযোগ রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘দশ টাকার জিনিস ৩০-৫০ টাকায় কেনা হচ্ছে। কেনা হলেও তা ঠিকমতো খালাস করা হচ্ছে না। পণ্য ঠিক মতো ব্যবহার হচ্ছে না। যেটা প্রয়োজন সেটা কেনা হচ্ছে কি না, যা কিনছে তা সত্যিই দরকার আছে কি না, যার দরকার আছে তাকে সময় মতো দেয়া হচ্ছে কি না, এমন অনেক প্রশ্নই রয়েছে।’
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘এরকম একটা জাতীয় দুর্যোগের মধ্যে শুধুমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেখানে পারছে না, তাদের ওপর একচেটিয়া নির্ভরশীলতা থেকে বের হওয়া ছাড়া কোনো উপায় দেখা যাচ্ছে না। সামাজিকভাবেই এসব সেবা গ্রাহকদের কাছে নিয়ে যেতে হবে। সেটি না করে ডিজিএইচএস এর ওপর শুধু নির্ভরশীল থাকলে হবে না। তাদের সক্ষমতার বাইরে তো পারবে না। তাদের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা রয়েছে, বিশেষ করে ব্যবস্থপনার ক্ষেত্রে। সোজা কথায় দুর্নীতির ক্ষেত্রে যদি দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন না আসে, তাহলে এ অবস্থার উন্নতি হবে না।’
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সবসময়ই হেলথ সেক্টরের ব্যয় তারা করতে পারতো না। আগে ব্যয়টা একটু কম ছিল, তাদের ওপর এতো চাপ ছিল না। কিন্তু এটা তো ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি। এই সিচুয়েশনে এটা হওয়া উচিত না, কিন্তু হচ্ছে। এখন ব্যয় করতে না পারা দুর্ভাগ্যজনক।
‘দুটি কারণে স্বাস্থ্য খাতের এ অবস্থা। একটি দুর্বলতা, অপরটি করাপশন। এ দুটি সমস্যা এক সঙ্গে আসে। প্রকল্পের দুর্ললতার কারণে প্রকল্পের টাকা ব্যয় করতে পারে না। এক দিকে টাকা খরচ করে পারে না, অপর দিকে আনফেয়ার ওয়েতে বিভিন্ন কন্ট্রাক্টগুলো যায়। যে কারণে প্রকিউরমেন্ট (কেনাকাটা) বন্ধ হয়ে যায়। এতে ডিসভার্সমেন্টও (অর্থ ছাড়) বন্ধ হয়ে যায়। এর সঙ্গে সক্ষমতার অভাব তো রয়েছেই।’
অর্থ প্রাপ্তিতে শীর্ষ পাঁচে, খরচে তলানির দশে স্বাস্থ্য
আইএমইডির প্রতিবেদন বলছে, গত অর্থ বছরের এডিপির বরাদ্দে শীর্ষ পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের একটি ছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু বছর শেষে কাজের দিক দিয়ে সরকারের ৫৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে স্বাস্থ্যের অবস্থান ৪৯তম বা তলানিতে থাকা ১০টির একটি।
বরাদ্দে স্বাস্থ্যের ওপরে থাকা মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগে ৮৯ দশমিক ৭১ শতাংশ, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে ৮৮ শতাংশ, স্থানীয় সরকার বিভাগ ৮১ দশমিক ৪৪ শতাংশ অর্থ খরচ করেছে।
শীর্ষ বরাদ্দ পাওয়াদের মধ্যে স্বাস্থ্যের চেয়ে কম বরাদ্দ পেয়েও রেলপথ মন্ত্রণালয় ৮৫ শতাংশ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ১০১ দশমিক ২৯ শতাংশ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রায় ৮২ শতাংশ এবং ১০৪ দশমিক ২৭ খরচ করেছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। এমনকি কৃষি মন্ত্রণালয়ও ৯৭ দশমিক ৫২ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন দেখিয়েছে।
খরচের সামর্থ্য না থাকলেও নিয়েছে বাড়তি অর্থ
বছরের শুরু থেকেই ভালো অবস্থায় ছিল না স্বাস্থ্য খাত। গত অর্থ বছরের মূল এডিপিতে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগে বরাদ্দ ছিল ৯ হাজার ৭৩৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভাগটি খরচ করতে পেরেছিল মাত্র ২ হাজার ৮১ কোটি টাকা যা বরাদ্দের ২১ শতাংশ।
এরপরও মার্চ মাসে এডিপি সংশোধনের সময় আরও ২ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা বাড়তি বরাদ্দ নেয় বিভাগটি। তবে বছর শেষে মূল বরাদ্দ থেকেই ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা কম খরচ করেছে তারা।
খরচের হাত খোলা ছিল স্বাস্থ্যের জন্য
করোনার সময় অর্থ ব্যয়ে লাগাম টানতে বিভিন্ন খাতের কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে খরচ কমানোর পাশাপাশি উন্নয়ন প্রকল্পের একটা অংশও সংরক্ষণ করতে বলা হয়েছিল। গত ডিসেম্বরে করোনাভাইরাস মহামারিতে ব্যয় কমানো নীতিতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) সরকারি অংশ থেকে ২৫ শতাংশ অর্থ আটকে রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয় এর আওতাভুক্ত ছিল না।
এ বছরের মার্চে অর্থ বিভাগের অপর নির্দেশনায় বলা হয়, উন্নয়ন প্রকল্পের সরকারি অংশের ১৫ শতাংশ অব্যয়িত রেখে বাকি ৮৫ শতাংশ খরচ করা যাবে। এখানেও স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতকে আওতার বাইরে রাখা হয়। এর আগে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন খাতে গাড়ি কেনা স্থগিত করা হয় আগামী জুন পর্যন্ত।