করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে ডেঙ্গু বিপর্যয় উদ্বিগ্ন করে তুলেছে চিকিৎসকদের। তারা বলছেন, দুটি রোগের আক্রমণ একসঙ্গে হলে চিকিৎসা পদ্ধতির জটিলতা বাড়ে। এতে বেশি ঝুঁকি তৈরি হয় আক্রান্ত রোগীর।
চলতি বছর এখন পর্যন্ত (রোববার) সারা দেশে ডেঙ্গু শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ৮৯৫। এর মধ্যে জুলাইয়ে শনাক্ত হয়েছেন ২ হাজার ২৮৬ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রোববার রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ৮২৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন করোনাতেও আক্রান্ত বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিড মহামারির মধ্যে করোনা ও ডেঙ্গু নিয়ে যেসব রোগী হাসপাতালে আসছেন তাদের অনেকেরই স্বাস্থ্য জটিলতা বেশি। আগামীতে এ ধরনের রোগী বাড়লে পরিস্থিতি মারাত্মক হতে পারে।
এর কারণ ব্যাখ্যা করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা ও ডেঙ্গুর চিকিৎসা আলাদা হওয়ায় সমস্যা তৈরি হচ্ছে। করোনা আক্রান্ত অনেকের ক্ষেত্রে রক্ত জমাটের প্রবণতা থাকে। তবে ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে বিষয়টি আলাদা। ফলে দুটি রোগের চিকিৎসা পদ্ধতিতেও পার্থক্য রয়েছে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. টিটো মিঞা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনা এবং ডেঙ্গু একসঙ্গে ভয়াবহ হতে পারে। দুইটা যখন একসঙ্গে থাকবে তখন কিছু জিনিস বেড়ে যেতে পারে, যদি কেয়ারফুল না হওয়া যায়। মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায় দুইটা একসঙ্গে হলে।’
তিনি বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে রোগী দেরিতে হাসপাতালে আসে। রোগীদেরও তাদের নিজেদের স্বাস্থ্যের বিষয়ে সন্দেহ করতে হবে। আমরাও ম্যানেজ করার চেষ্টা করব।’
ডা. টিটো মিঞা বলেন, ‘কোনো কোনো ডেঙ্গুতে কোনো বিপদ থাকে না। কারণ সব ক্ষেত্রে ডেঙ্গু রোগীর ব্লিডিং হয় না। তবে ব্লিডিং থাকলে আর যদি করোনা থাকে তবে ব্লাড সিনাপ ব্যবহারের দরকার নেই। প্লাটিলেট কমে গেলে ভীত হওয়া যাবে না যতক্ষণ না ব্লিডিং হয়।’
তিনি জানান, কেউ একসঙ্গে করোনা ও ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে করোনা আক্রান্ত হিসেবেই মৃত্যু নথিভুক্ত হচ্ছে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এএসএম আলমগীর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দুইটা (করোনা ও ডেঙ্গু) একসঙ্গে হলে একটা বড় ইফেক্ট তো হবেই। এ ধরনের পেশেন্টকে ট্রিটমেন্টের জন্য করোনা হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।’
এ ধরনের ক্ষেত্রে জটিলতার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গুতে যদি ব্লিডিং থাকে, সে রকম ক্ষেত্রে আসলেই কঠিন অবস্থা হবে।’
তবে খুব বেশি উদ্বিগ্ন না হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ বি এম আবদুল্লাহ।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনা বা ডেঙ্গু যেটাই হোক না কেন, সেটি কিন্তু সব ক্ষেত্রে খারাপ না। বেশিরভাগ রোগীই বাসায় থেকে ভালো হচ্ছে।
‘দুটি একসঙ্গে হলেই যে খুব খারাপ হবে, তা নয়। তবে খারাপ হতে পারে। ডেঙ্গুর হেমোরেজিক রোগী বেশি খারাপ হয়, যেটাকে শক সিনড্রোম বলে।’
ডেঙ্গু ও করোনার লক্ষণ প্রায় কাছাকাছি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে এখন অবহেলা করা যাবে না। অনেকেই বাসায় ওষুধ খান। তবে শুধু নাপা খেতে হবে। অন্য কোনো ব্যথার ওষুধ খাওয়া যাবে না। খেলে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বেড়ে যাবে।
‘কেউ একসঙ্গে দুটো পজেটিভ হলে অবশ্যই ডাক্তার সিনড্রোম দেখে ওষুধ দেবেন। যেহেতু এটা ভাইরাস, এর কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ নেই। তাই আলাদা আলাদা লক্ষণ অনুযায়ী সেবা দিতে হবে।’
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. মোতলেবুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কারও যদি করোনা ও ডেঙ্গু একসঙ্গে হয় তাহলে কোনোভাবেই তার বাসায় থাকা উচিত হবে না। তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।’
এ ধরনের রোগীদের বিপরীতমুখী চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হচ্ছে জানিয়ে এ অধ্যাপক বলেন, ‘করোনাতে রক্ত জমাট বাঁধার একটা প্রবণতা থাকে। আমরা রক্ত পাতলা করার ওষুধ দিচ্ছি। অন্যদিকে ডেঙ্গু আক্রান্তদের রক্তপাতের সম্ভাবনা থাকে। তাই রক্ত পাতলা করার ওষুধ দিলে ব্লিডিং হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এসব ক্ষেত্রে একটু কন্ট্রোভার্সিয়াল কন্ডিশন দাঁড়িয়েছে।’
একসঙ্গে ডেঙ্গু ও করোনা আক্রান্ত রোগী এখন পর্যন্ত অনেকটা কম হলেও চিকিৎসকদের আশঙ্কা, যেকোনো সময় এ সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের আরেক সহযোগী অধ্যাপক ডা. পার্থ প্রতিম দাশ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার কাছে এখন দিনে ১০টা জ্বরের রোগী এলে তার মধ্যে তিনটা বা চারটা করোনার রোগী পাচ্ছি। সেই সঙ্গে দুই থেকে তিনটা ডেঙ্গু রোগী পাচ্ছি।
‘তবে প্রতিদিন না হলেও এক-দুই দিন পর একজনকে পাচ্ছি, যার দুইটাই পজেটিভ আছে।’
তিনি বলেন, ‘এমন অনেক হচ্ছে যে, ডেঙ্গুর জন্য ট্রিটমেন্ট নিতে গিয়ে কেউ করোনা পজেটিভ হয়েছে। আবার একইভাবে করোনা চিকিৎসা চলার সময় ডেঙ্গু পজেটিভ হয়েছে। এখন যদি ডেঙ্গু কন্ট্রোল করা না যায়, তবে মারাত্মক সমস্যা হবে।’