করোনার টিকাকেন্দ্রের সামনে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন সত্তরোর্ধ্ব নুরজাহান বেগম। প্রায় ৯ কিলোমিটার দূর থেকে ভ্যানে এসে কোমর ব্যথায় কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। নাতনিকে ধরে তবু লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, কারণ করোনার টিকা না নিয়ে বাড়ি যাবেন না।
তিনি বলেন, ‘গ্রামে সবার সর্দি জ্বর লেগে আছে। আমি বয়স্ক মানুষ। আরও কিছু দিন বাঁচতে ইচ্ছা করে, তাই টিকা নিতি চলে আলাম।’
নুরজাহানের মতো এমন শতাধিক প্রবীণ টিকা নিতে মঙ্গলবার ভিড় করেন মাগুরা নার্সিং ইনস্টিটিউটের সামনে। জেলা সিভিল সার্জন অফিসের বাম পাশেই দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে টিকা নেন তারা।
স্বেচ্ছাসেবীরা জানান, কোরবানির ঈদের পর কঠোর লকডাউনের মধ্যেই মঙ্গলবার সকাল থেকে মাগুরা সদর হাসপাতালের এ টিকাদানকেন্দ্রে ছিল মানুষের উপচে পড়া ভিড়। টিকা দেয়া শুরুর পর বয়স্কদের এমন ভিড় দেখেননি তারা।
সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত টিকা নেয়ার সময় থাকলেও প্রচণ্ড ভিড়ের জন্য সকাল ৮টা থেকে টিকা দেয়া শুরু করে জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়। চলে বিকেল ৫টা পর্যন্ত।
এ নার্সিং ইনস্টিটিউটে টিকা নিতে আসা ৬৯ বছরের সেতারা বেগম বলেন, ‘প্রথমে টিকা নিইনি। দেখতে চেয়েছি নতুন টিকা কেমন কাজ করে। এখন বুঝতে পেরেছি, টিকা আসলে সবাইকে নিতে হবে। না হলে এই মহামারি থেকে আমাদের নিস্তার নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘বৃষ্টির মধ্যেই চলে এসেছি। তবে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকাটা এই বয়সে খুব কষ্টের। কয়েকটি বুথ করলে মানুষের ভোগান্তি কমত।’
মঙ্গলবার দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে টিকা নেন মাগুরাবাসী
৭৭ বছরের জোছনা খাতুন বলেন, ‘মালিকগ্রাম থেকে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে টিকা নিতি আইছি। এতদিন মনে করতাম টিকা নিলি বুঝি কাজ হবি নে। কিন্তু এহন বুঝি টিকা নেয়া ছাড়া এই করোনা থেকে বাঁচা যাবি না।’
তিনি জানান, বয়স্কদের জন্য আলাদা লাইন ও বুথ হলে ভালো হয়। বিশেষ করে যাদের বয়স ৬০-এর বেশি। এসব মানুষদের অধিকাংশই দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না।
মাগুরা স্বাস্থ্যবিভাগ জানিয়েছে, জেলায় এখন সিনোফার্মের টিকা দেয়া হচ্ছে। ঈদের আগে টিকা নিয়েছেন প্রতিদিন গড়ে ৮০০ থেকে ১ হাজার জন। তবে ঈদের পর ২৪ থেকে ২৭ জুলাই পর্যন্ত টিকা নিয়েছেন গড়ে দেড় হাজার জন।
এরমধ্যে রেকর্ড সংখ্যক টিকা দেয়া হয়েছে মঙ্গলবার। এ দিন তিন হাজারের বেশি মানুষ টিকা নিয়েছেন। টিকা গ্রহীতাদের বেশিরভাগের বয়স ৬০-এর বেশি। তবে পুরুষের চেয়ে নারীরা তুলনামূলক কম টিকা নিয়েছেন।
সিভিল সাজর্ন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মাগুরায় এখন পর্যন্ত সিনোফার্মের টিকা নিয়েছেন ১২ হাজার ৫৬২ জন। তাদের মধ্যে পুরুষ ৬ হাজার ৭০১ ও নারী ৫ হাজার ৫৫০ জন। এ ছাড়া ভারতের কোভিশিল্ড টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৪৮ হাজার ৪৪৫ জন। আর দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ২৮ হাজার ৬৬৮ জন।
কার্যালয় থেকে আরও জানানো হয়, মাগুরা সদর হাসপাতাল ছাড়াও পৌর এলাকায় আরও তিনটি কেন্দ্র থেকে টিকা দেয়া শুরু হয়েছে। আবালপুর গ্রাম, বীর মুক্তিযোদ্ধা আছাদুজ্জামান ইনডোর স্টেডিয়াম ও নিজনান্দুয়ালী স্কুল প্রাঙ্গণে মঙ্গলবার থেকে টিকা দেয়া শুরু হয়। দুই দিন ধরে ভিড় বাড়ায় এসব বুথ খোলা হয়েছে।
৪০ জনের বেশি নার্স এক সঙ্গে কাজ করছেন জানিয়ে নার্স সুপারভাইজার জাহানারা বেগম বলেন, ‘প্রশিক্ষিত নার্সরা কেন্দ্রে ভিড় বুঝে টিকা দিচ্ছেন। যেই কেন্দ্র মানুষ বেশি হচ্ছে, সেখানে নার্সের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। তবে টিকাগ্রহীতার সংখ্যা বাড়লে আরও প্রশিক্ষিত জনবল দরকার হবে।’
সিভিল সার্জন শহীদুল্লাহ দেওয়ান বলেন, ‘কয়েক দিন ধরে দেখা যাচ্ছে, টিকা নিতে বেশ আগ্রহ মানুষের। বিশেষ করে ঈদের পর আজ (মঙ্গলবার) প্রচণ্ড ভিড় ছিল। এটা খুবই ভালো একটা দিক যে, মানুষ সচেতন হচ্ছে। টিকা নিতে দূরদূরান্ত থেকে কেন্দ্রে আসছে।
‘যদিও আমাদের লোকবল সংকট, তবু চেষ্টা করছি সবাই যেন টিকা নিয়ে বাড়ি যেতে পারেন। টিকাগ্রহীতা থাকা পর্যন্ত টিকা কার্যক্রম চলমান থাকবে।’
সামাজিক দূরত্ব রক্ষায় লোকবল বাড়ানোর কথা জানিয়ে সিভিল সার্জন বলেন, ‘আরও বেশি টিকার বুথ দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আশা করি, মানুষের যা একটু ভোগান্তি তা দূর করতে পারব।’