বাংলাদেশ ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে করোনার একেকটি টিকা কিনেছে ৪ ডলার বা তার চেয়ে কমে। আর চীন থেকে কত দামে টিকা কেনা হয়েছে, সেই বিষয়ে চূড়ান্ত তথ্য পাওয়া না গেলেও সরকারের ক্রয় কমিটিতে ১০ ডলারে অনুমোদনের তথ্য এসেছে গণমাধ্যমে।
ন্যায্যতার ভিত্তিতে বিশ্বজুড়ে টিকা বিতরণে গড়ে ওঠা জোট কোভ্যাক্স থেকে যে টিকা পাওয়া যাচ্ছে, তার দাম সিরামের টিকার অর্ধেকের মতো।
অথচ স্বাস্থ্যবিধি মানতে জনগণের প্রতি ‘আকুল আবেদন জানিয়ে’ পত্রিকায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞাপনে টিকার পেছনে অর্থ পরিশোধের যে হিসাব দেয়া হয়েছে, তাতে প্রতিটি টিকার দাম পড়ে তিন হাজার টাকা।
এই বিজ্ঞাপনের তথ্য চমকে দিয়েছে স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্টদের। সরকার এতদিন টিকার দাম নিয়ে যা বলে আসছে, তার সঙ্গে এই তথ্যের কোনো মিল নেই।
তবে বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখে কুলুপ। ব্যাখ্যা জানতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তাকে ফোন করা হলেও এ বিষয়ে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজির আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিজ্ঞাপনে টিকার অস্বাভাবিক খরচ দেখানো হয়েছে। এটা কীভাবে হলো জনগণকে সঠিক ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন।’
সরকারপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি ইকবাল আর্সলান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘৫ ডলারে যদি সিরামের টিকা দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে এর দাম পড়বে ৪৫০ টাকা। এটি বেড়ে কীভাবে ৩ হাজার টাকা হলো, সেটি আমার বুঝে আসে না। বাকি আড়াই হাজার টাকা কোন খাতে খরচ হলো, এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা করা উচিত।’
তিনি বলেন, ‘টিকার দাম ৪ ডলার ছিল। এ বিষয়ে ওপেন চুক্তি হয়েছে। কীভাবে দাম বেড়ে এত হলো, এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে জিজ্ঞাসা করেন।’
স্বাচিপের আরও এক নেতা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেন, ‘টিকার দাম নিয়ে কিছুদিন আগে দেশে বড় ধরনের একটি ঘটনা ঘটেছে। এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দাম প্রকাশের দুই-এক ঘণ্টার মধ্যে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কীভাবে টিকার বাড়তি দাম প্রকাশ করল? এটা অবশ্যই সরকারের ভুল হয়েছে। এখন সরকারের উচিত হবে এ বিষয়টি নিয়ে ব্যাখ্যা দেয়া।’
পত্রিকায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই বিজ্ঞপ্তি অনুসারে প্রতিটি টিকার দাম পড়ে ৩ হাজার টাকা, কিন্তু বাংলাদেশ টিকা কিনেছে এর চেয়ে অনেক কম দামে
বিভিন্ন দৈনিকে ৯ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞাপন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ১ কোটি ১ লাখ ৫০ হাজার ডোজ করোনার টিকা কিনেছে। এতে বাংলাদেশের খরচ হয়েছে ৩ হাজার ৪৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি ডোজ তিন হাজার টাকা।
যদিও চলতি বছরের ১০ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ টিকা কিনেছে মোট ৯০ লাখ। এই টিকার মধ্যে বাংলাদেশ সিরাম থেকে কিনে এনেছে ৭০ লাখ টিকা। আর চীন থেকে কিনেছে ২০ লাখ।
সিরাম থেকে টিকা কেনার ক্ষেত্রে লোকাল এজেন্ট হিসেবে ভূমিকা রেখেছে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস। প্রতিষ্ঠানটির চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) রাব্বুর রেজা নিউজবাংলাকে জানান, সিরামের টিকা কেনার ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয় গত ৫ নভেম্বর আর ১৩ ডিসেম্বর হয় ক্রয় চুক্তি। চুক্তির পক্ষ তিনটি- বাংলাদেশ সরকার, সিরাম ও বেক্সিমকো।
টিকা কিনতে সিরাম ইনস্টিটিউটটের অ্যাকাউন্টে অগ্রিম দুই দফায় দেড় হাজার কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। তবে যত টাকা দেয়া হয়েছে টিকা এসেছে তার চেয়ে অনেক কম।
প্রতি ডোজ টিকার জন্য সিরামকে ৪ ডলার ধরা হয়েছে। তবে চুক্তিটা এমন যে, ভারত সরকার ৪ ডলারের কমে টিকা কিনলে বাংলাদেশও সেই দাম দেবে আর ভারত সরকার ৪ ডলারের বেশিতে টিকা কিনলে বাংলাদেশ দেবে ৪ ডলারই। আর টিকা সংরক্ষণ, পরিবহন ও বিতরণের জন্য বেক্সিমকো ফার্মা নেবে ১ ডলার করে।
অর্থাৎ সিরামের টিকার দাম কোনোভাবেই ৫ ডলারের বেশি হওয়ার সুযোগ নেই। অবশ্য সিরাম থেকে ৩ কোটি ৪০ লাখ টিকা কেনার পরিকল্পনা থাকলেও বাংলাদেশে ৭০ লাখ পাঠানোর পর ভারত সরকারের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞায় তারা আর টিকা পাঠাতে পারেনি। আবার বাংলাদেশের দেয়া অগ্রিম টাকা আটকে আছে সেখানে।
সিরাম থেকে টিকা না পেয়ে বাংলাদেশ যোগাযোগ করে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে।
এর মধ্যে সরকারি ক্রয় কমিটিতে চীনের টিকা ১০ ডলার ধরে দাম অনুমোদনের কথা সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়। কিন্তু এই সংবাদ প্রকাশের পর চীন নাখোশ হয়। কারণ, তারা বিশ্বের অন্যান্য দেশে এর চেয়ে বেশি দামে টিকা বিক্রি করেছে। বাংলাদেশের দাম প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় দেশটি বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে।
এ নিয়ে টানাপোড়েনের কারণে একপর্যায়ে টিকা প্রাপ্তিই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। যদিও পরে সমাধান হয় আর গত ৩ জুলাই প্রথম চালানে পাঠানো হয় ২০ লাখ টিকা।
এ ছাড়া টিকা বিতরণের বৈশ্বিক জোট কোভ্যাক্স থেকে মডার্না ও ফাইজার টিকা মিলিয়ে ২৬ লাখ টিকা দেশে এসেছে। এগুলোর দাম দুই ডলার করে পড়বে বলে সরকার আগেই জানিয়েছে।
কোনোভাবেই টিকার দাম তিন হাজার টাকা হয় না। তাহলে বিজ্ঞাপনে কেন এত টাকার কথা বলা হলো- জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, ‘বিভিন্ন দেশ থেকে আগের কিছু টিকা কেনা রয়েছে। আরও টিকা কেনার জন্য অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। এখানে সেই হিসাবটি দেখানো হয়েছে।’