সরকারি হাসপাতালে করোনাভাইরাস মহামারির সময় গণমাধ্যমের কাছে রোগী ও স্বাস্থ্য সেবা বিষয়ক তথ্য দেয়ায় নিষেধাজ্ঞা জারিতে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। একইসঙ্গে অবিলম্বে এই নির্দেশনা বাতিলের দাবিও জানিয়েছে সংস্থাটি।
শনিবার টিআইবি থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ কথা জানানো হয়।
এতে বলা হয়েছে, অবাধ তথ্য প্রবাহের মাধ্যমে সামষ্টিকভাবে মহামারি নিয়ন্ত্রণে সর্বাত্মক প্রয়াস চালানোর বিপরীতে কাদের স্বার্থে এ ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা হলো, তা খতিয়ে দেখে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হোক।
স্বাস্থ্য বিভাগের ঢাকা জেলার আওতাধীন চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টরা গণমাধ্যমে রোগ ও রোগীদের সম্বন্ধে কোনো তথ্য দিতে পারবেন না বলে বৃহস্পতিবার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন সিভিল সার্জন আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান।
ঢাকার সিভিল সার্জনের সই করা ওই নিষেধাজ্ঞা বিভিন্ন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।
দেশে করোনাভাইরাসে শনাক্ত ও মৃতের সংখ্যার ব্যাপক ঊর্ধ্বগতির মধ্যে এমন নিষেধাজ্ঞা দেন ঢাকার সিভিল সার্জন।
নির্দেশনায় বলা হয়, ‘…ঢাকা জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট সকলের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, বিরাজমান কোভিড-১৯ মহামারিকালীন পরিস্থিতিতে সিভিল সার্জন ব্যতীত অন্য কাউকে টিভি চ্যানেল কিংবা কোনো প্রকার প্রিন্ট মিডিয়ার নিকট স্বাস্থ্যসেবাবিষয়ক কর্মকাণ্ড অথবা রোগ ও রোগীদের সম্পর্কে কোনো ধরনের তথ্য আদান-প্রদান বা মন্তব্য না দেয়ার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে।
‘একই সঙ্গে প্রিন্ট মিডিয়ার ব্যক্তিবর্গকে রোগীর ছবি তোলা, ভিডিও করা অথবা সাক্ষাৎকার ধারণ করা থেকে বিরত থাকার নিমিত্তে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা যাচ্ছে। এহেন কর্মকাণ্ড রোগীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভঙ্গের শামিল। এতদসংক্রান্ত কোনো তথ্য-উপাত্ত নেয়ার প্রয়োজন হলে সরকারি সিভিল সার্জন ঢাকার সহিত যোগাযোগ করার অনুরোধ করা হলো।’
বিষয়টি নিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দেশে বর্তমানে কোভিড-১৯ অতিমারির সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে এবং আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় প্রতিদিনই রেকর্ড ছাড়াচ্ছে। এমন সময় ঢাকা জেলার সরকারি হাসপাতালগুলোর স্বাস্থ্য ও রোগীর সেবা বিষয়ক যে কোনো তথ্য গণমাধ্যমের কাছে প্রকাশে বিধিনিষেধ আরোপ মুক্ত গণমাধ্যম ও অবাধ তথ্য প্রবাহের সাংবিধানিক অধিকার এবং তথ্য অধিকার আইনে পাওয়া ‘তথ্য জানার অধিকার’ এর পুরোপুরি লঙ্ঘন।
‘একই সঙ্গে এটি স্বাধীন ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং গণমাধ্যমের অবাধ তথ্য সংগ্রহ ও প্রচারে ইচ্ছাকৃতভাবে বাধা দেয়ার শামিল।’
দেশে করোনা মহামারি শুরুর সময়েও রাষ্ট্রীয়ভাবে এ ধরনের বিধিনিষেধ আরোপের চেষ্টা ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে বাতিল করতে হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অতিমারি নিয়ন্ত্রণে চলা লকডাউনে এমনিতেই সাধারণের জন্য তথ্যপ্রাপ্তির সুযোগ সংকুচিত, সেখানে গণমাধ্যমকে তথ্য না দেয়ার এমন নির্দেশ মানুষকে স্বাস্থ্যসেবার হালনাগাদ তথ্যপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করবে, তেমনি মাঠ পর্যায়ের হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতার সত্যিকারের চিত্র পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে, যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।’
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এখানে প্রশ্ন হচ্ছে আদেশের সূত্র হিসেবে সিভিল সার্জন যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনার কথা বলেছেন তারা কারা? এবং কী উদ্দেশ্যে স্থানীয়ভাবে তথ্যের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন? এটি অতিমারি নিয়ন্ত্রণে কী সুফল বয়ে আনবে? সেটি জরুরি ভিত্তিতে পরিষ্কার করতে হবে এবং বারবার এ ধরনের বিধিনিষেধ আরোপের অশুভ প্রয়াসের চক্র বন্ধে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে।’
স্বাস্থ্যখাতে চলা অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার তথ্য গোপনের অভিপ্রায়ের অংশ হিসেবে এই আদেশ কীনা এমন সন্দেহ জানিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘এ নির্দেশনা জারির পরদিনই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দশটির বেশি জাতীয় দৈনিকে রাষ্ট্রীয় তথা জনগণের অর্থব্যয়ে ‘করোনার ভয়াবহতা ঠেকাতে বিধিনিষেধ আন্তরিক ও কঠোরভাবে পালনের আকুল আবেদন’ শীর্ষক বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে সাম্প্রতিক সময়ে স্বাস্থ্যখাতে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি সংঘটিত হয়নি বলে সাফাই গাইবার অপচেষ্টা করেছেন।
তিনি বলেন, ‘অথচ গত এক বছরে স্বাস্থ্যখাতের নিয়োগ, ক্রয়, অবকাঠামো নির্মাণ ও সেবাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগুনতি অনিয়ম-দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার সংবাদ পত্রিকার পাতা খুললেই পাওয়া যায়।স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সর্ম্পকিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে উত্থাপিত প্রতিবেদনেও যা প্রতিভাত হয়েছে।’
ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, ‘টিআইবির সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোতেও এ খাতে সুশাসনের ঘাটতির নানা চিত্র উঠে এসেছে, যা বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। তাই এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ এবং তথ্য প্রদানে নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে মূলত স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা ঢাকার প্রচেষ্টা একই সূত্রে গাঁথা বলে মনে করা মোটেও অবান্তর হবে না।’