খুলনা বিভাগের শহর-গ্রামে নজিরবিহীনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে করোনা। জেলা, উপজেলার হাসপাতালে রোগীর চাপ সামলাতে চিকিৎসকেরা হিমশিম খাচ্ছেন।
এই বিভাগে ৫ জুলাই মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ৫০ অতিক্রম করে। বৃহস্পতিবারেও মারা গেছেন ৫১ জন। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি খুলনা, যশোর ও কুষ্টিয়া জেলায়। আর সবচেয়ে কম মাগুরায়।করোনাভাইরাসের ব্যাপক বিস্তারের জন্য স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতাকে দায়ী করছেন খুলনা অঞ্চলের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, উপসর্গ দেখা দেয়ার পর করোনা পরীক্ষায় গড়িমসি এবং দেরিতে হাসপাতালে যাওয়ার কারণে বাড়ছে মৃত্যু।খুলনা বিভাগে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় চুয়াডাঙ্গায় গত বছরের ১৯ মার্চ। গত বছর সংক্রমণ পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এ বছর ব্যাপক অবনতি হয়েছে। করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত বিভাগের ১০ জেলায় করোনা শনাক্ত হয়েছে মোট ৬৭ হাজার ৫৩১ জনের দেহে। কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১ হাজার ৪১৬ জন।
জেলাভিত্তিক করোনা-সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, খুলনা জেলায় এ পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছেন ১৭ হাজার ৮৯৮ জন, যাদের মধ্যে মারা গেছেন ৩৬৯ জন।
বাগেরহাট জেলায় মোট শনাক্ত ৪ হাজার ২৭৪ জন, মারা গেছেন ৯৬ জন।
সাতক্ষীরা জেলায় এ পর্যন্ত মোট করোনা শনাক্ত ৪ হাজার ৫০ জন এবং মারা গেছেন ৭৬ জন। যশোর জেলায় মোট শনাক্ত হয়েছেন ১৪ হাজার ৫২৫ জন, মারা গেছেন ১৯৩ জন।
নড়াইল জেলায় মোট করোনা শনাক্ত ৩ হাজার ২৫০ জন, মারা গেছেন ৫৭ জন। মাগুরা জেলায় মোট শনাক্ত হয়েছেন ১ হাজার ৯২২ জন, মারা গেছেন ৩৪ জন।
এ ছাড়া, ঝিনাইদহ জেলায় মোট করোনা শনাক্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৩২০ জন, মারা গেছেন ১১৮ জন। কুষ্টিয়া জেলায় শনাক্ত হয়েছেন ৯ হাজার ৬৬৩ জন, মারা গেছেন ২৯৬ জন।
চুয়াডাঙ্গা জেলায় এ পর্যন্ত করোনা শনাক্ত হয়েছে মোট ৪ হাজার ২৬৬ জনের দেহে, মারা গেছেন ১০৯ জন। মেহেরপুর জেলায় শনাক্ত হয়েছেন ২ হাজার ৩৬৩ জন, মারা গেছেন ৬৮ জন।পরিসংখ্যান বলছে, আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে খুলনার পরেই রয়েছে যশোর ও কুষ্টিয়া। এর পর আছে ঝিনাইদহ, বাগেরহাট, চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা, নড়াইল ও মেহেরপুর। এখন পর্যন্ত মাগুরায় সবচেয়ে কম আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছে।
জনসচেতনতাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা
খুলনা সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি না মানাই সংক্রমণ বৃদ্ধির বড় কারণ। এর ফলে বেড়ে চলেছে আক্রান্তের সংখ্যা। এ ছাড়া দেরি করে পরীক্ষা করা এবং হাসপাতাল বা বাসাবাড়িতে করোনা রোগীর সঙ্গে দেখা করা ব্যক্তিদের মাধ্যমে সংক্রমণ বহুগুণ বাড়ছে।’
খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক সুহাস রঞ্জন হালদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যারা আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের বেশির ভাগই হাসপাতালে আসছেন শেষ মুহূর্তে। ততক্ষণে তাদের শারীরিক অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ছে। বেশির ভাগ রোগীর অক্সিজেন লেভেল নেমে যাচ্ছে ৮০-এর নিচে। এ সমস্ত রোগীই মৃত্যুর তালিকা বাড়াচ্ছেন।’খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপাধ্যক্ষ ও জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক ডা. মেহেদী নেওয়াজ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যেসব রোগী গ্রাম থেকে এসে ভর্তি হচ্ছেন, তাদের বেশির ভাগই জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকেন। দেখা যায় তাদের অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৮০-এর নিচে। প্রথম থেকে তারা যথাযথ চিকিৎসা নেননি অথবা করোনার পরীক্ষা করিয়েছেন অনেক দেরিতে। ফলে সংক্রমণে দেহের যে ক্ষতি হওয়ার সেটা আগেই হয়ে যাচ্ছে। পরীক্ষা বা ট্রিটমেন্ট গোড়াতেই শুরু হলে হয়তো তাদের বাঁচানো সম্ভব হতো।’
খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. রাশেদা সুলতানা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যেসব রোগীর ডায়বেটিস, হার্টের সমস্যা রয়েছে; লিভারের রোগে আক্রান্ত ও ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত; অ্যাজমা, হাইপারটেনশন, প্রেশার রয়েছে তারা করোনা আক্রান্ত হলেই অক্সিজেন লেভেল কমে যাচ্ছে। চিকিৎসকেরা চেষ্টা চালিয়েও তাদের বাঁচিয়ে রাখতে পারছেন না। এ ছাড়া দেখা গেছে বেশি মারা যাচ্ছেন বয়স্ক রোগীরা।’
করোনা আক্রান্তদের দেরি করে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন ডুমুরিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবদুল ওয়াদুদ।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গ্রামের মানুষ ভয়ে অনেকে পরীক্ষা করাচ্ছেন না। আবার কেউ কেউ করোনাকে আমলে নিচ্ছেন না। তারা মনে করছেন, সারা দিন কঠোর পরিশ্রম করায় করোনায় তাদের কিছু হবে না।
‘অন্যদিকে কেউ আক্রান্ত হলে সাধারণ সর্দি-কাশি ধরে নিয়ে হাসপাতালে যেতে দেরি করছেন। তারা সর্দি-কাশির সাধারণ ওষুধ খাচ্ছেন। অবস্থা খারাপের দিকে গেলে তারপরেই তারা উপায় না দেখে হাসপাতালে আসছেন।’