করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আবার শুরু হচ্ছে গণটিকাদান কার্যক্রম। দুই মাসের বেশি সময় পর বুধবার আবার চালু করা হয়েছে টিকা পাওয়ার জন্য নিবন্ধন সাইট ‘সুরক্ষা’। কিন্তু প্রথম দিনই দেখা দিয়েছে সার্ভার জটিলতা। এতে ভোগান্তির কথা জানিয়েছেন অনেকেই।
কেউ কেউ বলছেন, ১০ থেকে ১৫ বার চেষ্টা করেও সুরক্ষা ওয়েবসাইটে (www.surokkha.gov.bd) প্রবেশ করতে পারছেন না। বিষয়টি স্বীকার করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও।
সংস্থাটি বলছে, শুরুর দিকে একই সময়ে অনেক মানুষ নিবন্ধন করতে সাইটে ঢুকতে চেষ্টা করার কারণে একটু জটিলতা তৈরি হয়েছে। এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে। প্রাথমিক অবস্থায় একটু চাপ থাকবে। আস্তে আস্তে চাপ কমে যাবে।
করোনার টিকাদানে নিবন্ধন আবার শুরু হচ্ছে- গণমাধ্যমে এমন সংবাদ আসার পর বুধবার সকাল থেকেই সুরক্ষা সাইটে হুমড়ি খেয়ে পড়েন অনেকে। তেমনই একজন গুলশানের বাসিন্দা সবুজ আহমেদ।
ইন্টারনেটে ১০ থেকে ১২ বার চেষ্টা করেও ‘সুরক্ষা’ সাইটের দেখা পাননি সবুজ। তিনি বলেন, ‘নিবন্ধন করতে পারছি না। এর আগেও আমি নিবন্ধন করতে পারিনি। টিকা পাই বা না পাই নিবন্ধনটা করতে পারলে একটু স্বস্তি অনুভব করতাম।’
নিবন্ধন করতে না পেরে হতাশা প্রকাশ করলেন বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা তৌফিক আহমেদ। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘গতকাল রাতে একবার সুরক্ষা ওয়েবসাইটে ঢুকতে পেরেছিলাম, তবে নিবন্ধন করতে পারিনি। সকাল থেকে অনেকবার চেষ্টা করেও ওয়েবসাইটে ঢুকতে পারছি না। এ ছাড়া সঠিক সময়ে টিকা পাওয়া নিয়েও দুশ্চিন্তায় আছি।’
গণমাধ্যমকর্মী সৌগত বসু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আজ সকালে নিউজ দেখার পর আমি সুরক্ষা অ্যাপে ঢোকার ট্রাই করি। কয়েকবার চেষ্টা করেও ঢুকতে পারিনি। নিবন্ধন অপশনে গেলে লোডিং দেখায়। পূর্ণাঙ্গ সাইট শো করে না। এরপর আবার দুপুরে চেষ্টা করেও ঢুকতে পারিনি। আই অ্যাম ডিসেপয়েন্টেড।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, প্রথম দফায় ১২ লাখ নিবন্ধিত মানুষ যারা এক ডোজ টিকাও পাননি এবং নতুন করে যারা নিবন্ধন করেছেন, তারা আগামী সপ্তাহের মধ্যেই টিকাকেন্দ্রের নামসহ এসএমএস পাবেন। কেন্দ্রে এসে তারা টিকা নিতে পারবেন।
সার্ভার জটিলতা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘বড় পরিসরে গণটিকার জন্য নিবন্ধন শুরু হয়েছে। শুরুর দিকে অধিক মানুষ একসঙ্গে নিবন্ধন করতে চাইলে একটু জটিলতা তৈরি হয়। আমাদের বিশ্বাস, প্রাথমিক পর্যায়ে এই চাপ থাকবে। যতদিন গড়াবে সেই চাপ কমে যাবে। আমরা এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) পরিচালক ডা. শামসুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘টিকা বিতরণের জন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বৃহস্পতিবারের মধ্যে টিকা পৌঁছে যাবে বিভিন্ন কেন্দ্রে। সিটি করপোরেশনের ১২টি কেন্দ্রে দেয়া হবে মডার্নার টিকা। আর জেলা ও উপজেলার কেন্দ্রে দেয়া হবে চীনের উৎপাদিত সিনোর্ফামের টিকা।’
টিকাসংকটের কারণে গত ৫ মে নিবন্ধন কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। মূলত দেশে করোনা প্রতিরোধী টিকা কার্যক্রম শুরু হয়েছিল অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দিয়ে।
ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত এ টিকার ৩ কোটি ৪০ লাখ ডোজ কেনার জন্য চুক্তি করেছিল সরকার। চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ করে টিকা দেয়ার কথা ছিল সিরামের। তবে ৭০ লাখ পাঠানোর পর সিরাম আর টিকা দিতে পারেনি সরকারি নিষেধাজ্ঞায়।
কেনা টিকার বাইরে বাংলাদেশকে ৩৩ লাখ ডোজ টিকা উপহার হিসেবে পাঠিয়েছে ভারত সরকার। ভারত থেকে টিকা আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরই টিকার বিকল্প উৎসের সন্ধানে নামে বাংলাদেশ। চীন ও রাশিয়ার টিকা পেতে নানা ধরনের আলোচনা চলছে।
চীন থেকে এরই মধ্যে টিকা আসা শুরু হয়েছে। টিকা আসছে ন্যায্যতার ভিত্তিতে বিশ্বজুড়ে করোনা টিকা বণ্টনের জোট কোভ্যাক্স থেকেও।
গত শুক্র ও শনিবারই সরকার হাতে পেয়েছে ৪৫ লাখ ডোজ টিকা। এগুলো চীনের সিনোফার্মের বিবিআইবিপি-করভি ও যুক্তরাষ্ট্রের মডার্নার টিকা। এর বাইরেও উপহার হিসেবে দুই দফায় বাংলাদেশকে ১১ লাখ টিকা দিয়েছে চীন। ফাইজারের টিকাও এসেছে লক্ষাধিক ডোজ।
এর বাইরে বিভিন্ন উৎস থেকে আরও টিকা পাওয়ার আশ্বাস মিলেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই আবার গণটিকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল সরকার। এবার টিকাদানের পরিসরও বাড়াচ্ছে সরকার। বয়সের সীমা কমিয়ে করা হয়েছে ৩৫ বছর। এর আগে টিকাগ্রহীতার বয়সের সীমা ৪০ বছর নির্ধারণ করেছিল সরকার।
এবার যাদের অগ্রাধিকার
করোনা প্রতিরোধী টিকা প্রদানে এবার যাদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে, তারা হলেন করোনা মোকাবিলায় সামনের সারির যোদ্ধা, নির্বাচিত প্রতিনিধি, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার কর্মকর্তারা, সব ধর্মের প্রতিনিধি, মৃতদেহ সৎকারকাজে নিয়োজিত কর্মীরা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, নিষ্কাশন ও ফায়ার সার্ভিসের প্রথম সারির কর্মকর্তা, রেলওয়ে স্টেশন, বিমানবন্দর, নৌবন্দর, স্থলবন্দরের কর্মচারীরা, সামরিক বাহিনীর সদস্য, জেলা-উপজেলায় জরুরি কাজে নিয়োজিত সরকারি কর্মচারী, ব্যাংক কর্মকর্তা ও কর্মচারী, জাতীয় দলের খেলোয়াড়, চিকিৎসাসংশ্লিষ্ট বিভাগের ছাত্রছাত্রী, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের ছাত্রছাত্রী, গণমাধ্যমকর্মী, স্বাস্থ্য ও পরিবার মন্ত্রণালয়ের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী, অনুমোদিত সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, রাষ্ট্র পরিচালনায় নিয়োজিত অপরিহার্য কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
যে প্রক্রিয়ায় নিবন্ধন
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, সুরক্ষা অ্যাপে জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধন সনদ দিয়ে নিবন্ধন করতে হবে। ফোন ও জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, নাম, জন্মতারিখের পাশাপাশি কোনো শারীরিক জটিলতা আছে কি না, পেশা কী তাও জানাতে হবে।
স্মার্টফোনে ইন্টারনেট সংযুক্ত করে অ্যাপটি ডাউনলোড করা যাবে। অ্যাপে তথ্য দিলে টিকার আপডেট সম্পর্কে গ্রহীতাদের এসএমএসের মাধ্যমে জানানো হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ টিকা বিতরণ করতে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।
প্রথম দফায় টিকা পেতে নিবন্ধন করেন ৭২ লাখ ৮০ হাজার ১৩১ জন। এর মধ্যে দুই ডোজ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা পেয়েছেন ৪২ লাখ ৯০ হাজার ৯৬৪ জন। দ্বিতীয় ডোজ পেতে বাকিদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।