পারসিস্টেন্ট জেনিটাল অ্যারাউসাল ডিজর্ডার (পিজিএডি) নামের রোগটি নিয়ে আক্রান্তদের পাশাপাশি পরিষ্কার ধারণা নেই চিকিৎসকদেরও। অনেক বিশেষজ্ঞ একে বলছেন স্নায়ুর রোগ। বিরল এই রোগটি নিয়ে সংবাদ ও কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সভিত্তিক সাইট ভাইস একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। নিউজবাংলার পাঠকদের জন্য সেটি অনুবাদ করেছেন রুবাইদ ইফতেখার।
ডালহৌসি ইউনিভার্সিটির ছাত্রী নোরা (ছদ্মনাম) গত আগস্টে কানাডার হ্যালিফ্যাক্স থেকে ক্যালগারিতে পরিবারের কাছে ফিরছিলেন। সেদিনের ফ্লাইটটি তার জীবনের অন্যতম নির্মম যাত্রায় পরিণত হয়। টাই-ডাই রঙের হুডি ও ধূসর ট্রাউজার পরা নোরাকে বারবার তলপেট খামছে ধরে নিশ্বাস নিতে হচ্ছিল। এর কারণ, তার শরীরে একের পর এক অর্গাজম। ছয় ঘণ্টার ফ্লাইটে প্রতি পাঁচ মিনিটে একবার তিনি অর্গাজমের শিকার হন।
চরম মুহূর্তে সামলাতে না পেরে প্রায় আধা ঘণ্টা পরপর তাকে বাথরুমে যেতে হচ্ছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নোরা বলেন, ‘বিষয়টা খুবই যন্ত্রণার। সব সময় চেষ্টা করতে হয়েছে যাতে তীব্র অর্গাজম না হয় বা পাশে বসা ব্যক্তি টের না পান।’
বাড়িতে ফেরার পরও প্রায় এক সপ্তাহ নোরাকে নিজের বেডরুমে একা কাটাতে হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘সেটা ছিল এক কঠিন পরিস্থিতি। কারণ দীর্ঘদিন আমি ওদের থেকে দূরে ছিলাম, বাসায় ফিরে সবার সঙ্গে সময় কাটাতে মুখিয়ে ছিলাম। অথচ বাড়ি ফিরে মোটেও স্বস্তি পাচ্ছিলাম না।’
শারীরিকভাবে নোরার অর্গাজম হতে থাকলেও মানসিকভাবে তিনি উত্তেজনা বোধ করছিলেন না। এটি আসলে একটি বিরল রোগ, যাকে চিকিৎসাশাস্ত্রে বলা হয় ‘পারসিস্টেন্ট জেনিটাল অ্যারাউসাল ডিজর্ডার’ বা পিজিএডি। এতে আক্রান্ত হলে স্বতঃস্ফূর্ত অর্গাজম, যৌনাঙ্গ ও স্তনে মৃদু কাঁপন ও টান লাগা, সারাক্ষণ যৌন কামনার অনুভূতি হওয়ার মতো উপসর্গ দেখা যেতে পারে।
সাধারণভাবে রোগটি মেয়েদের মধ্যে বেশি মাত্রায় দেখা গেলেও ছেলেদেরও এতে আক্রান্ত হওয়ার নজির রয়েছে। উত্তেজনার লক্ষণগুলোর সঙ্গে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যৌন আকাঙ্ক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই। এখন পর্যন্ত এর কোনো চিকিৎসাও নেই।
কুইনস ইউনিভার্সিটির ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ক্যারোলিন পুকাল যৌনস্বাস্থ্য ও অক্ষমতা নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বলেন, ডাক্তারদের মধ্যেও পিজিএডি নিয়ে খুব একটা জানাশোনা নেই। মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশ নারী বিরল এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, রোগটি নির্ণয় করা বেশ দুরূহ। প্রায়ই একে অতি-যৌনতার (হাইপার সেক্সুয়ালিটি) সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়। অন্য উপসর্গ বাদ পড়ার পর এর ডায়াগনসিস হয়।
যেসব রোগী পিজিএডির সমস্যা নিয়ে আসেন তাদের এক-তৃতীয়াংশের স্বতঃস্ফূর্ত অর্গাজম হয়। অর্ধেক রোগী বলেন, তাদের এই অভিজ্ঞতা প্রচণ্ড যন্ত্রণাদায়ক।
পুকাল জানান, এই রোগের লক্ষণ মাঝেমধ্যে আসে। হঠাৎ করে বেড়ে যেতে পারে। যৌনতার ছবি, এমনকি গাড়ির হালকা ঝাঁকুনি থেকেও এটি শুরু হয়ে যেতে পারে।
তিনি বলেন, ‘একে আমি অর্গাজমই বলতে চাই না। এটা একধরনের খিঁচুনির মতো। এতে আনন্দের কিছু নেই। এটা বিভ্রান্তি ও বিরক্তির অনুভূতি তৈরি করে।
‘অর্গাজম যেকোনো সময় হতে পারে বলে যাদের এটি হয় প্রায়ই তাদের যৌন শিকারি বা বিকৃত যৌনরুচির ভেবে ভুল করা হয়।’
পুকালের মতে, রোগটি আক্রান্তকে শারীরিকভাবে দুর্বল করে ফেলতে পারে। প্রায়ই দেখা রোগীদের সঠিক প্রশ্নটি করছেন না ডাক্তাররা। বিষয়টি পিজিএডিতে ভুগতে থাকা রোগীদের জন্য বাড়তি হতাশা তৈরি করতে পারে।
‘তারা আপনাকে অনেক সময়ই উপহাস করে বলবে যে আপনি ভাগ্যবান’, বলেন পুকাল।
বাস্তবে পিজিএডিতে আক্রান্তদের মধ্যে বিষণ্নতা ও উদ্বেগের সঙ্গে আত্মঘাতী মানসিকতা বৃদ্ধি পায়। পুকাল বলেন, ‘তারা কার্যকর চিকিৎসার অভাবে আশাহত হয়ে পড়েন।’
পিজিএডি নোরার জীবনকে নাটকীয়ভাবে বদলে দিয়েছে। মাঝেমধ্যে কোনো ধরনের লক্ষণ ছাড়াই কয়েক মাস পেরিয়ে যায় তার। তবে যখন আক্রান্ত হন তখন প্রায় প্রতি দুই মিনিটে একবার করে দিনে শতাধিক অর্গাজমের শিকার হন। গর্ভধারণ ছাড়াই তার স্তনগ্রন্থিও সক্রিয় হয়ে ওঠে।
তিনি বলেন, ‘এমনটা হলে আমি রান্না করতে পারি না, কোনো কাজ করতে পারি না। এমনকি কারও সঙ্গে ভালোভাবে কথাও বলতে পারি না। বিষয়টি একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার মতো।’
নিজের সবশেষ সেমিস্টারে নোরাকে তার অর্ধেক কোর্স বাদ দিতে হয়েছে। কারণ, তিনি হোমওয়ার্ক শেষ করতে পারেননি। তার বাবা রোগটি নিয়ে সচেতন না হয়ে বরং নোরার ঘরে বন্দি হয়ে থাকাকে ‘একধরনের আলস্য’ বলে বিদ্রুপ করেন।
নোরা এমন অবস্থায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কারণ তার মতে, এই রোগ নিয়ে কোনো পেশাদার পদে থাকা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। এ জন্য ভিন্ন কোনো ক্যারিয়ার খুঁজছেন তিনি।
চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়েও নোরার অভিজ্ঞতা হতাশাজনক। তিনি জানান, গত বছরে একাধিকবার রক্ত পরীক্ষা করেছেন এবং ছয়জন চিকিৎসককে দেখিয়েছেন। তাদের মধ্যে দুজন তার লক্ষণের কথা বিশ্বাসই করেননি।
কিছুদিন আগে করানো এমআরআই রিপোর্টে সব স্বাভাবিক আসায় তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। নোরা ও তার চিকিৎসক আশা করেছিলেন, তার মস্তিষ্ক বা মেরুদণ্ডের নিচে কোনো অস্বাভাবিক গ্রোথ দেখা যাবে। তবে সেটাও দেখা যায়নি।
নোরা বলেন, ‘আমি আশায় ছিলাম তেমন কিছু হলে সেটি চিকিৎসক কেটে ফেলতে পারবেন, আর আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব।’
নোরার সঙ্গে আর কাজ করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন তার থেরাপিস্ট। কারণ পিজিএডি নিয়ে আলোচনা তাকে অস্বস্তিতে ফেলছে।
এতে আরও হতাশ নোরা বলেন, ‘উনি কাজ করা বন্ধ করে দিলেন, তখন মনে হয়েছে বিষয়টি সত্যিই নোংরা ও যৌনতাপূর্ণ।’
পিজিএডি আক্রান্তদের প্রতি ড. অ্যান লুইস ওকল্যান্ডারের সোজাসাপ্টা পরামর্শ একজন নিউরোলজিস্ট (স্নায়ু বিশেষজ্ঞ) দেখানো।
ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের নিউরোলজিস্ট ওকল্যান্ডার পিএজিডি আক্রান্ত ১০ জন নারীকে নিয়ে একটি গবেষণাপত্র লিখেছেন। গত বছরের জানুয়ারিতে প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়, যৌনাঙ্গ থেকে অনুভূতি বহন করা স্নায়ুর বৈকল্য বা স্পাইনাল কর্ডে আঘাতের কারণে এমনটা ঘটতে পারে।
ওকল্যান্ডার বলেন, ‘ডাক্তার কিংবা চিকিৎসক কেউই নিউরোলজি নিয়ে ভাবছেন না। আমি এটা নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে চাই।’
ওকল্যান্ডার বলেছেন, গবেষণায় অংশ নেয়া ১০ জনের বয়স ১১ থেকে ৭০ বছর। তাদের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ কারণ ছিল স্নায়ুর গোড়া বা ওপরের দিকের সমস্যা। এর মধ্যে একজন নিয়মিত ওষুধ খাওয়া বন্ধ রাখায় এমনটা হয়েছে।
পুকালও লক্ষণগুলোর জন্য একই প্রভাবক লক্ষ করেছেন। বিশেষত যখন কেউ এসএসআরআই (অ্যান্টি ডিপ্রেস্যান্ট) ব্যবহার বন্ধ করে দেয়।
ওকল্যান্ডার বলেন, একবার নিউরোলজিস্ট যদি কোনো কারণ নির্ধারণে সক্ষম হন, তাহলে চিকিৎসক সম্ভাব্য ওষুধ বা অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতির পরামর্শ দিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে পারেন। নিশ্চিত কোনো চিকিৎসা না থাকলেও ওকল্যান্ডারের মতে, চিকিৎসকেরা কারণ খুঁজে পেয়েছেন এটাই রোগীকে অনেকটা স্বস্তি দিতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ২৯ বছরের ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের ড্যানিয়েলা (ছদ্মনাম) সম্প্রতি পিজিএডির জন্য চিকিৎসা শুরু করেছেন।
দুই সন্তানের মা ড্যানিয়েলা স্বতঃস্ফূর্ত অর্গাজমের শিকার হন না, কিন্তু তার যৌনাঙ্গ প্রায় সারাক্ষণ উত্তেজিত থাকে।
তিনি বলেন, ‘ভেবে দেখুন, আপনার সারা দিন হাঁচি পাচ্ছে, কিন্তু আপনি হাঁচি দিতে পারছেন না। এটা আমাকে একেবারে উদভ্রান্ত ও আদিম করে তোলে।’
ড্যানিয়েলা বিষণ্নতা ও উদ্বেগে ভোগেন। তার বিশ্বাস, এসএসআরআই ব্যবহার তার পিজিএডি লক্ষণগুলো আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। হাই স্কুল থেকেই তার এই লক্ষণ প্রকাশ পায়। কিন্তু সংরক্ষণশীল অ্যানাব্যাপটিস্ট ক্রিস্টিয়ান চার্চে বেড়ে ওঠায় তাকে শেখানো হয়েছে, ‘সচ্চরিত্র নারীরা বিশুদ্ধ কুমারী ও সুখী নারী, যারা তার পরিবারের খেয়াল রাখে।’ যে কারণে নিজের যৌনতা নিয়ে লজ্জায় থাকতেন তিনি।
ড্যানিয়েলা বলেন, ‘রোগ হিসেবে একে দেখার পর থেকে আমার জীবনে অনেক উন্নতি ঘটেছে।’
গত কয়েক মাসে তিনি মিশিগানের এক বিশেষজ্ঞসহ বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞকে দেখিয়েছেন। মিশিগানের বিশেষজ্ঞ তাকে ছয়টি ইনজেকশন দিয়েছেন, যাতে স্নায়ু অবশকারী উপাদান লিডোকেইন ও স্টেরয়েড ছিল। ড্যানিয়েলা তার তলপেটে চাপ কমানোর জন্যও থেরাপি নিচ্ছেন। তার মতে, তলপেটে চাপের কিছুটা উন্নতি হয়েছে, এখন আক্রান্ত হওয়ার পর কম ব্যথা অনুভব করছেন।
ড্যানিয়েলা গত কয়েক মাসে তার পিজিএডি চিকিৎসার জন্য প্রায় ৫ হাজার ডলার খরচ করেছেন।
ড্যানিয়েলা ও নোরা দুজনই পিজিএডি আক্রান্তদের জন্য ফেসবুক গ্রুপে যুক্ত হয়ে স্বস্তি পেয়েছেন। গ্রুপগুলোতে আক্রান্তরা তাদের লক্ষণ ও চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন এবং ভালো চিকিৎসকের নাম-ঠিকানা আদান-প্রদান করেন।
নোরা জানান, তিনি ও তার বন্ধুদের মধ্যে ভালো একটা সাপোর্ট সিস্টেম তৈরি হয়েছে। এতে তার মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হচ্ছে।
নোরা বলেন, ‘সারা জীবন এমন একটা কিছু নিয়েই আমাকে থাকতে হবে। এটা নিয়ে আমি আর রাগ করি না। বরং একে কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, সেটা নিয়েই ভাবতে থাকি।’
তিনি জানান, মেডিটেশনও তাকে অনেক সাহায্য করেছে।
ড্যানিয়েলা তার স্বামীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে খোলাখুলি কথা বলা শুরু করেছেন। তিনি বলেন, ‘মনে যা ছিল সবই তাকে (স্বামী) খুলে বলেছি। সে আমাকে বিশেষ কোনো চোখে দেখেনি। এটা আমাদের দুজনের জন্যই অনেক ভালো হয়েছে।’