করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নয়নে মনোযোগী হচ্ছে সরকার। এ জন্য প্রায় এক লাখ ডাক্তার, নার্স, টেকনিশিয়ানসহ অন্যান্য লোকবল নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
বৃহস্পতিবার বিষয়টি নিউজবাংলাকে নিশ্চিত করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন।
তিনি জানিয়েছেন, শূন্য পদে নিয়োগের পাশাপাশি নতুন পদও তৈরি করা হবে। এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানোর জন্য কাজ শুরু করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সরকারপ্রধান অনুমোদন করলেই নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হবে।
বাংলাদেশে জেলা ও উপজেলা হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার, নার্স ও টেকনিশিয়ান স্বল্পতার অভিযোগ নতুন নয়। ২০২০ সালের মার্চে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ার পর দেশের বড় হাসপাতালগুলোতেই সুযোগ-সুবিধাসহ লোকবলের অপ্রতুলতার বিষয়টি সামনে আসে। এ সময় অ্যাডহক ভিত্তিতে কয়েক হাজার চিকিৎসককে নিয়োগও দেয়া হয়।
কিন্তু এবার দীর্ঘমেয়াদের কথা চিন্তা করে স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজাতে চাইছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা হিসাব করেছিলাম এক লাখেরও বেশি লোক লাগবে। এগুলো আমরা এখন হিসাব করছি পদ সৃষ্টির জন্য।’
এই উদ্যোগ কোন পর্যায়ে আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেছি। ওনাকে আমরা বিষয়টি অবহিত করেছি। আমাদের ডাক্তার, নার্স এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী আরও নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন রয়েছে। উনিও বলেছেন বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব সহকারে দেখবেন।’
করোনার চিকিৎসায় শয্যা বাড়ানোর বিষয়টি তুলে ধরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘প্রতিটি হাসপাতালে কোভিডের জন্য আমরা বেড বাড়িয়েছি। সব মিলিয়ে প্রায় আড়াই হাজারের মতো। আগে আড়াই হাজার ছিল, এখন আড়াই হাজার মিলে মোট পাঁচ হাজার হলো। তারপর এখানেও (ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন হাসপাতালে) এক হাজার। তাহলে ছয় হাজার হয়ে গেল। ছয় হাজার বেড হলে জনবল তো সেই হারে দরকার।’
প্রাণঘাতী এই ছোঁয়াচে রোগের সংক্রমণ থেকে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে চিকিৎসাসেবা দিতে দ্বিগুণ ডাক্তার, নার্স, চিকিৎসাকর্মী লাগবে বলেও জানান মন্ত্রী। কারণ, এই রোগের চিকিৎসা শেষে ডাক্তার, নার্সরা ১৫ দিন পরপর আইসোলেশনে যান।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ইমিডিয়েট পাঠিয়ে দিচ্ছি। তারপর ওখান থেকে (প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) অনুমোদন হয়ে আসলে আমরা কার্যক্রম শুরু করতে পারব। সংখ্যাটা এখনও ওনার ওপর নির্ভর করে। উনি যতজন নিতে বলবেন, অনুমতি দেবেন, আমরা ততজনকে নিয়োগ দেব। দেখি উনি কী দেন।’
দেশের ৩৭টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজেও লোকবলের অভাব রয়েছে। কিন্তু করোনা মহামারি সামাল দিতে জেলা হাসপাতালগুলোকে ১০০ থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। উপজেলা হাসপাতালগুলোকে ৩০ বেড থেকে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট করা হয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘২০২০ সালে আমরা যে সেটআপ তৈরি করেছি, আপনারা জানেন হাসপাতাল অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। জনবল কিন্তু আগেরটাই রয়ে গেছে।’
দেশের সরকারি হাসপাতালগুলো সচল করতে কী পরিমাণ লোকবল প্রয়োজন- জানতে চাওয়া হয় মন্ত্রীর কাছে।
জবাবে তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা হিসাব করেছিলাম এক লাখেরও বেশি লোক লাগবে। এগুলো আমরা এখন হিসাব করছি পদ সৃষ্টি করার জন্য।’
বিষয়টি সরকারপ্রধানকে জানানো হলে তিনি ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন বলেও জানান মন্ত্রী।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যত (লোকবল) লাগে তত আমরা দিয়ে দেব।’
তবে জুড়ে দিয়েছেন একটি শর্ত। প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথাযথভাবে সচল রাখতে হবে।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথাযথভাবে চালু করতে হবে। শুধু বিল্ডিং বানিয়ে রাখলেই হবে না। আমরা বিল্ডিং দেখি, বিল্ডিং বানানো হয়েছে জনগণের কথাটা ওভাবে ভাবা হয়নি। কিন্তু এখন জনগণ কত লাগবে সে অ্যাসেসমেন্ট করার কার্যক্রম চলছে।’
এ বিষয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে দুই-তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়িয়ে স্বাস্থ্য খাত উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য খাত ঢেলে সাজাতে আগামী ১০ বছর স্বাস্থ্যে কী ধরনের পরিবর্তন করা দরকার এই বিষয়ে মেগা পরিকল্পনা প্রয়োজন। তবে মহামারি মোকাবিলায় সরকারের তেমন কোনো প্রস্তুতি দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন করতে হলে মানুষের সুস্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে হবে। চিকিৎসাব্যয় কমিয়ে আনতে হবে। একই সঙ্গে চিকিৎসকদের মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ করতে হবে। ওষুধ কোম্পানি, চিকিৎসক ও বিক্রয় প্রতিনিধিদের অশুভ ও অনৈতিক তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে।’
জাফরুল্লাহ চৌধুরী আরও বলেন, ‘বাজেটে বরাদ্দ ব্যয় বাড়ালেই চলবে না। কোথায় ব্যয় হবে সেটা আগে নিশ্চিত করতে হবে। মেডিক্যাল শিক্ষা বরাদ্দ বাড়াতে হবে। চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী বৃদ্ধি করতে হবে। তারা যাতে গ্রামে গিয়ে কাজ করতে পারে, এটাও নিশ্চিত করতে হবে। এমনকি শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় তাদের গ্রামে কিছু সময় থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিবছর ১০ হাজার শিক্ষার্থীকে এক মাস গ্রামে রাখতে যে খরচ হবে, সেটিও সরকাকে বহন করতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাজেট যদি গুণগত ব্যয় করা হতো, তাহলেও উন্নয়ন করা সম্ভব হতো। তবে বরাদ্দকৃত অর্থ দুর্নীতি-অদক্ষতার কারণে ঠিকমতো ব্যয় করতে পারে না। একই সঙ্গে মহামারির মধ্যে প্রতিনিয়ত স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে করোনা চিকিৎসার জন্য কেনা যন্ত্রপাতির।
তিনি বলেন, অনেক যন্ত্রপাতি কিনে বছরের পর বছর ফেলে রাখা হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দের টাকা একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে খরচ করতে হবে। এ ছাড়া প্রতিবছর কিছু টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়, সেটা কর্মচারীদের বেতনে চলে যায়। স্বাস্থ্য গবেষণায় ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, যেটা গত বছরেও ছিল তবে কোনো টাকাই খরচ হয়নি। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে উন্নত গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা অত্যন্ত জরুরি। আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন গবেষণার ক্ষেত্রে সব ধরনের সহায়তা সরকারের দেয়া উচিত।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. মো. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘বাজেটের অর্থ দুর্নীতি হয়, তাহলে বরাদ্দ বাড়িয়ে লাভ নেই। বরাদ্দ অর্থ দুর্ন ীতিবাজদের পকেটে চলে যাবে। মহামারির মধ্যে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ অর্থ যথাযথ জায়গায় ব্যয় হচ্ছে কি না এটি তদারকি প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘অর্থ বরাদ্দ বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে জনবল সংকট নিরসন করতে হবে। হাসপাতালগুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও বিপুলসংখ্যক জনবল নিয়োগ করে জনগণের যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। জোর দিতে হবে শিক্ষা ও গবেষণায় ৷ আমরা যদি টিকা উৎপাদন করতে পারতাম এবং আমাদের সে ধরনের সক্ষমতা থাকত, তাহলে টিকা নিয়ে এ অবস্থা হতো না। বিভিন্ন দেশ আমাদের জিম্মি করতে পারত না। টিকা ক্রয়ে বাজেটে আলাদা বরাদ্দ দিতে হবে।’