কঠোর লকডাউনের পরও রাজশাহীর করোনা সংক্রমণ কমছে না। সেই সঙ্গে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের করোনা ইউনিটে মৃত্যুও থামছে না। করোনা ইউনিটে বেডের তুলনায় সব সময়ই রোগীর সংখ্যা বেশি থাকছে। এই চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। একের পর এক ওয়ার্ড রূপান্তরিত হচ্ছে করোনা ওয়ার্ডে।
এ অবস্থায় সোমবার আরও একটি ওয়ার্ডকে করোনা ইউনিটে যুক্ত করা হয়েছে। করোনা ওয়ার্ড করার জন্য কাজ চলছে আরও দুটিতে। কিন্তু সামলানো যাচ্ছে না রোগী।
এদিকে ১ হাজার ২০০ বেডের এ হাসপাতালে এখন প্রায় ৪০০-এর বেশি করোনা রোগীর চিকিৎসা দিতে গিয়ে সাধারণ চিকিৎসা পড়েছে ঝুঁকির মুখে। হাসপাতালে সাধারণ রোগীদের মাঝেও করোনা ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এ পরিস্থিতিকে ভয়ংকর হিসেবেই দেখছেন চিকিৎসাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তারা বলছেন, লকডাউনে কোনো ফল মিলছে না, কারণ, ঘরে ঘরে করোনা ছড়িয়ে পড়েছে। এখন সব থেকে জরুরি হলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা।
রামেকে ধারণক্ষমতা ছাড়িয়ে গেছে করোনা রোগী। চাঁপাইনবাবগঞ্জে কঠোর লকডাউন শেষে বিশেষ বিধিনিষেধ চলছে। আর রাজশাহী শহরে ১২ দিন ধরে চলছে কঠোর লকডাউন। কিন্তু দুই জেলায় সংক্রমণের সংখ্যা কমছেই না। থামছে না মৃত্যুও।
রোগীর হিসাব
সবশেষ সোমবার সকাল থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত রামেকের করোনা ইউনিটে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে ৫ জনের করোনা পজিটিভ ছিল। বাকি ৮ জন মারা গেছেন উপসর্গ নিয়ে।
চলতি মাসে তিন সপ্তাহে এই হাসপাতালের করোনা ইউনিটে মারা গেছেন ২২৯ জন। এদের মধ্যে বেশির ভাগই রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের।
কঠোর লকডাউনের পরও রামেকে করোনা রোগী বেড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় এখানে নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন ৫৬ জন। আগের ২৪ ঘণ্টায় এ সংখ্যা ছিল ৬২ জন। সোমবার সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ৬১ জন।
রোববার সকালে করোনা ইউনিটে চিকিৎসাধীন রোগী ছিলেন ৩৭৭ জন। আর সোমবার সকালে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ৪০২ জনে। আবার মঙ্গলবার এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৯৩ জনে। ৩০৯ বেডের বিপরীতে এসব রোগীকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। বাড়তি রোগীরা আছেন চরম ঝুঁকিতে। কারণ, বেডে জায়গা না হওয়ায় তারা সেন্ট্রাল অক্সিজেন সুবিধা পাবেন না।
অথচ এখন যারা হাসপাতালে ভর্তি আছেন, তাদের সবার জন্যই জরুরি অক্সিজেন। সিলিন্ডার অক্সিজেন দিয়ে তাদের সেবা দেয়া হচ্ছে, এতেও তাদের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
রামেকে করোনা ইউনিট
যেভাবে রোগী বাড়ছে, সেভাবে চিকিৎসা দেয়ার সক্ষমতা বাড়ানো যাচ্ছে না। ফলে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ ছাড়া করোনা রোগীদের জন্য নতুন নতুন ওয়ার্ড বাড়ানোর কারণে অন্য রোগের চিকিৎসা কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
এ অবস্থায় সোমবার দুপুরে এখানকার আরেকটি ওয়ার্ডকে যুক্ত করা হয়েছে করোনা ইউনিটে। এটির বেডসংখ্যা ৪৮টি।
কোভিড রোগীদের চিকিৎসার জন্য রামেক হাসপাতালে একের পর এক সাধারণ ওয়ার্ডকে করোনা ওয়ার্ডে রূপান্তর করা হচ্ছে। এখন হাসপাতালের ১, ৩, ১৫, ১৬, ১৭, ২২, ২৫, ২৭, ২৯, ৩০, ৩৯ ও ৪০ নম্বর ওয়ার্ডে করোনা রোগী রাখা হয়।
এ ছাড়া নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ২০টি ও কেবিনে ১৫টি করোনা ডেডিকেটেড শয্যা আছে। ১৭ নম্বর ওয়ার্ডটি যুক্ত হওয়ায় মোট শয্যা হলো ৩৫৭টি।
চিকিৎসকদের ভাবনা
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. নওশাদ আলী বলেন, ‘পরিস্থিতি এখন আর আমাদের নিয়ন্ত্রণে নাই। এখন ঘরে ঘরে করোনা ছড়িয়ে পড়েছে। লকডাউন দিয়েও ফল মিলছে না।
‘এ অবস্থায় খুব জরুরি হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। বাড়িতে থাকলেও একজন আরেকজনের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। প্রয়োজনে ঘরেও মাস্ক পরতে হবে।
‘কারণ বাড়ির বাইরে বের না হয়েও অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন অন্যের মাধ্যমে। এ অবস্থায় কাউকে বিশ্বাস করার সুযোগ নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিকল্প নাই।’
নওশাদ আলী আরও বলেন, ‘আমরা দেখছি কোনো পরিবারে একজনের করোনা হলে অন্যদেরও করোনা হচ্ছে। আর চিকিৎসা পরিস্থিতিও দিন দিন খারাপই হচ্ছে। হাসপাতাল করোনা রোগীতে ঠাঁসা। পরিস্থিতির যদি উন্নতি না হয় তাহলে আমাদের করণীয় কী, এটা নিয়ে এখনই ভাবতে হবে।
‘বিকল্প হাসপাতালের কথা ভাবতেই হবে। এটা নিশ্চিত যে, পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ভয়ংকর অবস্থার দিকেই যাচ্ছি আমরা। এ জন্য আমরা নির্মাণাধীন শিশু হাসপাতালের কথা ভাবতে পারি। সেটির কাজ দ্রুত শেষ করে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারি।’
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানীও বলেন, ‘প্রতিনিয়ত আমরা চেষ্টা করছি আমাদের ওয়ার্ড বৃদ্ধি করে রোগীদের একুমডিভেট করার। আমাদের এখানে যারা আসছে এদের সবারই অক্সিজেনের সমস্যা।
‘এদেরকে অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে রাখা খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে। একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার মাত্র দেড় ঘণ্টা যায়। সে জন্য একজন রোগীরে জন্য ২৪ ঘণ্টায় ১৬টি সিলিন্ডার লাগছে। সিলিন্ডার দিয়ে রোগী ম্যানেজ করা খুবই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এ জন্য আমরা সেন্ট্রাল অক্সিজেন ও অক্সিজেন কনস্যালটেন্ডের মাধ্যমে এদের ম্যানেজ করার চেষ্টা করছি। আমাদের বর্তমানে ৭৫২টি অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে।’
এখন কী করা যায়, এমন প্রশ্নের জবাবে শামীম ইয়াজদানী বলেন, ‘ওয়ার্ডগুলোকে ফাঁকা করে করোনা ইউনিট ঘোষণা করলেও হয়। কিন্তু আসলে এটি হচ্ছে না। এখানে যেসব রোগী থাকছে তাদের অক্সিজেন দিয়ে ফুলফিল করতে পারছি না। এ জন্যই আমরা পরিস্থিতি ভয়াবহ বলছি।
‘প্রত্যেকের বাসায় করোনা বাড়ছে। এখন লকডাউনও চলছে। আমাদের এখানে ভারতীয় বা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট আছে। সঠিক সময় আমরা সঠিক কাজটি করতে পারিনি। এ জন্যই আজকে করোনা রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে।’
গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি ৬২ জনের মধ্যে গ্রামের রোগী ৩৬ জন। আর শহরের ২৬ জন। এখন ৬০ শতাংশের ওপরে রোগী গ্রাম থেকে আসছে।
হাসপাতাল পরিচালক বলেন, ‘এখন আমার কাছে মনে হচ্ছে লকডাউনের চেয়েও স্বাস্থ্যবিধি মানাটা জরুরি। লকডাউন থাকবে। স্বাস্থ্যবিধি না মানলে কোনো লাভ নাই। সম্মিলতভাবে এটি কন্ট্রোল করতে না পারলে এটি আরও খারাপ হতে পারে।’
‘আমাদের এখানে বর্তমানে করোনা রোগী বাদে প্রায় ৬০০-এর মতো রোগী আছে। এগুলোর মধ্যে ৪০০-এর মতো জরুরি রোগী। কিডনী রোগী আছে, হার্টের রোগী আছে। এরপরও আমরা ৪ ও ১৪ নং ওয়ার্ডেও অক্সিজেন লাইন বসানোর কাজ করছি। এগুলোকেও করোনা ইউনিটে যুক্ত করা হবে।’