ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ার পর সীমান্তের জেলাগুলোতে এক মাস ধরে বাড়ছে করেনাভাইরাসের প্রকোপ। সীমান্তবর্তী নয়, এমন অঞ্চলেও উদ্বেগজনক হারে ছড়িয়ে পড়েছে করোনা সংক্রমণ।
গত দুই সপ্তাহে আরও ১৪টি জেলা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর মধ্যে আটটি জেলা সীমান্তবর্তী নয়। এগুলো হলো: নড়াইল, পিরোজপুর, নোয়াখালী, নাটোর, যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর ও টাঙ্গাইল।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ৩ জুন ৩৬টি জেলা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। গত দুই সপ্তাহে এটি বেড়ে ৫০ জেলাকে ঝুঁকিপূর্ণ করা হয়েছে। এসব জেলায় এই দুই সপ্তাহে মৃত্যু ও সংক্রমণ দুটিই বেড়েছে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ এবং গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ১০ শতাংশের বেশি সংক্রমণের হার থাকা জেলাগুলোকে ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আর ৫-৯ শতাংশ সংক্রমণের হার থাকা জেলাগুলোকে মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ ও ৫ শতাংশের নিচের জেলাকে স্বল্প ঝুঁকির অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত এক সপ্তাহে করোনায় আক্রান্তের হার ৫৫ দশমিক ১৬ শতাংশ বেড়েছে। মৃত্যুর হার বেড়েছে ৪৬ দশমিক ৩০ শতাংশ। এর সঙ্গে কিছুটা বেড়েছে নমুনা পরীক্ষা হার। গত এক সপ্তাহে এ হার বেড়েছে ২২ দশমিক ১৪ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, বিভাগ অনুযায়ী গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে খুলনা বিভাগে। গত ৫ জুন এই বিভাগে রোগী হয়েছিল ২৫২ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় এটি দাঁড়িয়েছে ৬২৫ জনে। অর্থাৎ ১৪ দিনে সনাক্ত তিন গুণ বাড়ল। এই বিভাগে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া, বাগেরহাট ও সাতাক্ষীরায়। গত দুই সপ্তাহ ধরে এসব জেলায় প্রতিদিন শতাধিক রোগী শনাক্ত হচ্ছে।
শনাক্ত ও মৃত্যু দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম। এই বিভাগে গত ২৪ ঘন্টায় মৃত্যু হয়েছে ১১ জনের। এই সময়ের মধ্যে শনাক্ত হয়েছে ৪০১ জন রোগী। এই বিভাগে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি চট্টগ্রাম সদর, কক্সবাজার, ফেনী, কুমিল্লা ও চাঁদপুরে।
মৃত্যুর দিক থেকে তৃতীয় স্থানে রয়েছে রাজশাহী। এ বিভাগে ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহী বিভাগে শনাক্ত হয়েছে ৩৪৫ জন। গত ৫ জুন শনাক্তের সংখ্যা ছিল ২৮৮। রাজশাহী সদর হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে।
২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনায় ৬৭ জন মারা গেছেন, যা গত দেড় মাসে সর্বোচ্চ। এর আগে ২ মে এর চেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছিল, ৬৯ জন।
উদ্বেগজনকভাবে দেশব্যাপী দৈনিক করোনা শনাক্তের হার দুই সপ্তাহ আগের ১১ শতাংশ থেকে বেড়ে গতকাল ১৮ দশমিক ০২ শতাংশে পৌঁছেছে। আগের দিন এই হার ছিল ১৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতি জন্য সরকারি, বেসরকারি এবং জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে চাপ সামলানো সঠিক হবে বলে মত তাদের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্য কমিটির সদস্য ডা. আবু জামিল ফয়সাল নিউজবাংলাকে বলেন, সম্প্রতি আইডিডিআরবির এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার করোনাভাইরাসের ৬৮ শতাংশ নমুনায় ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। এটা ঢাকার জন্য খুবই উদ্বেগের। ভ্যারিয়েন্ট ছাড়াও জনগণের স্বাস্থ্যবিধি প্রয়োগের ব্যাপারে শৈথিল্যও করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির জন্য দায়ী। গত দুই সপ্তাহ ঢাকা বাইরে জেলাগুলোতে সংক্রমণ বেড়েছে। এমন পরিস্থিত কিছু দিনের মধ্যে ঢাকাতেও আসতে পারে।
তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, জনগণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে খুলনা বা রাজশাহীর মতোই খারাপ অবস্থা দেখা দিতে পারে রাজধানীতে। তাই এখনই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ দিলেন এই বিশেষজ্ঞ। স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলেও জানান তিনি। এমন পরিস্থিতি প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা বাড়ানো ও করোনা আক্রান্তের সংস্পর্শে আসার ব্যক্তিদের আলাদা করে আইসোলেশনে রাখার পরামর্শ তার।
এ বিষয়ে আইইডিসিআরের পরিচালক ডা. তাহমিনা শিরীন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কোভিডের ডেলটা (ভারতীয়) ভ্যারিয়েন্টটি ইতোমধ্যে কমিউনিটি পর্যায়ে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। সংক্রমণের যে ধরন, তা দেখে মনে হচ্ছে, এটার সামাজিক সংক্রমণ ঘটেছে।’
তৃতীয় ঢেউ ফিরে আসার আশঙ্কা প্রকাশ করে ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, ‘গত দুই সপ্তাহে খুলনা রাজশাহী ও চট্টগ্রামে উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে সংক্রমণ। এটি প্রতিরোধে পরীক্ষা বাড়ানো ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। সীমান্ত এলাকার মানুষ করোনা পরীক্ষায় তেমন আগ্রহী নয়। বিনামূল্যে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হলেও তারা আগ্রহী নয়।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘সীমান্ত জেলাগুলোতে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিদিন জুমে বৈঠক হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ইতোমধ্যে অনেক জেলায় লকডাউনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কিছু জেলায় সংক্রমণ কমে আসছে। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট কিছুটা হলেও উদ্বেগ ছড়িয়েছিল। তবে যে ধরনই আসুক না কেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে তা প্রতিরোধ করা সম্ভব।’