করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সব উপসর্গই থাকছে। কিন্তু অনেক সময় নমুনা পরীক্ষার আগেই মারা যাচ্ছেন রোগী। প্রতিদিনই এমন মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
করোনা পজিটিভ আর উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর তালিকা করছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের দেহ থেকে আর নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা হচ্ছে না। ফলে মৃত্যুর আগে তারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন কিনা সেটি নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, করোনার প্রথম ধাক্কার সময় যারা উপসর্গ নিয়ে মারা যেতেন তাদের দেহ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হতো। কিন্তু গেল কয়েকমাস ধরে আর সেটি করা হচ্ছে না। সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পর উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়াদের আর নমুনা নেয়া হয় না।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আরও বলছে, জনবল সংকটের কারণে এখন উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের নমুনা পরীক্ষা করা যাচ্ছে না। তবে তাদেরও নমুনা পরীক্ষা গেলে করোনায় মৃতের সঠিক হিসাবটা অন্তত পাওয়া যেত। এখন সেটি হচ্ছে না।
রামেক হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, মার্চ মাসে রামেক হাসপাতালে উপসর্গ নিয়ে মারা যান ২৯ জন। এপ্রিলে মারা যান ৪৪ জন। আর গত মে মাসে মারা যান ৭২ জন। চলতি জুন মাসের প্রথম দশ দিনে রামেক হাসপাতালে করোনা ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ৯২ জন। এর মধ্যে ৫৬ জন মারা গেছেন করোনা শনাক্ত হওয়ার পর।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বাকি ৩৬ জন মারা গেছে উপসর্গ নিয়ে। সর্বশেষ বুধবার সকাল থেকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত পাঁচজন মারা গেছেন উপসর্গ নিয়ে। ফলে মার্চ থেকে ১৭৭ জনের মৃত্যু করোনায় নাকি অন্য কোনো কারণে সেটি আর জানা হয়নি।
রামেক হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. সাইফুল ফেরদৌস বলেন, ‘করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়াদের মধ্যে যে কজনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল, তাদের পজিটিভ পাওয়া গেছিল। তাই তারা ধরে নেয়া হয় যে, তারা করোনায় মারা গেছেন। করোনা পরীক্ষার পর পজিটিভ অবস্থায় যারা মারা যান, তাদের সঙ্গে উপসর্গের মৃতদের হিসাব রাখা হয় না।’
উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়াদেরও স্বাস্থ্যবিধি মেনে দাফন সম্পন্ন করার জন্য বলা হয়।
এদিকে যারা করোনায় মারা যাচ্ছেন তাদের তালিকা যাচ্ছে সিভিল সার্জন অফিস ও বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয়ে। এই তালিকা পাঠানো হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। অধিদপ্তর প্রতিদিনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সেই তথ্যই পাঠায়। কিন্তু উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের নমুনা পরীক্ষা না হওয়ায় করোনায় প্রকৃত মৃতের সংখ্যা উঠে আসছে না।
এদিকে এই বিষয়টি নিয়ে কোনো নির্দেশনাও নেই বলে জানান রাজশাহী বিভাগের উপস্বাস্থ্য পরিচালক আনোয়ারুল কবীর।
তিনি বলেন, ‘আমার জানা মতে বিষয়টি নিয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। তবে আমরা কাজ করছি। বাড়তি যদি এই কাজগুলো দেয়া হয় তবে আমরা করব। না জেনে তো এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা যায় না। তবে যদি নিয়ম থাকে তবে এটি আমরা অবশ্যই করব।’
বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাবিবুল আহসান তালুকদার বলেন, ‘রামেক হাসপাতাল এবং সিভিল সার্জনের কার্যালয় শুধু করোনায় মৃতদের সংখ্যা জানায়। উপসর্গ নিয়ে কজন মারা গেল, সেই তথ্য পাঠানো হয় না। তবে উপসর্গে মারা যাওয়া রোগীদের নমুনা পরীক্ষা করা উচিত। তাহলে প্রকৃত সংখ্যাটা পাওয়া যাবে।’
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম ইয়াজদানী বলেন, ‘আমাদের এখানে লোকবল সংকট আছে। এ কারণে আমাদের ল্যাবটিই চালানো হচ্ছে স্বেচ্ছাসেবী দিয়ে। এখন আমাদের লাশ থেকে নমুনা নেয়া কিছুটা বিরতি আছে। তবে এটি আমরা আবারও শুরু করব।’
তিনি জানান, ‘এখন শুধু ভর্তি থাকা রোগী, তার স্বজন এবং হাসপাতালের চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং নার্সদের নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। প্রতিদিন হাসপাতালের পিসিআর ল্যাবে ৮০ থেকে ৯৪টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। সংক্রমণের হার প্রায় ৪০ শতাংশ।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. চিন্ময় দাস বলেন, ‘রাজশাহীতে এখন আরটি-পিসিআর ল্যাবের পাশাপাশি নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে ভ্রাম্যমাণ বুথ বসিয়ে র্যাপিড এন্টিজেন টেস্ট করানো হচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষ বিনামূল্যেই করোনার নমুনা পরীক্ষা করাতে পারছেন।’
তিনি বলেন, ‘হাসপাতালেও এমন একটি বুথ বসালে উপসর্গে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের দ্রুতই নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব। তাহলে মৃত ব্যক্তির স্বজনেরা জানতে পারবেন মৃত ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত ছিলেন কিনা। তাহলে দাফন-সৎকারের সময় যেমন সতর্কতা অবলম্বন করা যাবে তেমনি করোনায় মৃতের প্রকৃত সংখ্যাটাও জানানো যাবে।’
জনসচেতনতা তৈরিতে হলে মৃতের প্রকৃত সংখ্যাটা উঠে আসা দরকার বলেও মনে করেন এই চিকিৎসক।
রাজশাহীতে এন্টিজেন র্যাপিড টেস্ট হচ্ছে সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থাপনায়।
সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. এফএএম আঞ্জুমান আরা বেগম বলেন, ‘নগরীতে ১৩-১৪টি পয়েন্টে এই টেস্ট হচ্ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যদি চায়, তাহলে হাসপাতালের ভেতরেই একটা বুথ করা যাবে। তাহলে রোগীর স্বজনেরাও টেস্ট করাতে পারবেন, যারা ভাবছেন করোনা রোগীর সেবা করতে গিয়ে তিনি ঝুঁকিতে পড়েছেন। তাছাড়া মৃত ব্যক্তিদেরও তাৎক্ষণিক নমুনা পরীক্ষা করা যাবে।’