সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন গাজীপুরের পুবাইলের ভাদুন এলাকার পোশাকশ্রমিক তপন বিশ্বাস। প্রসববেদনা উঠলে স্ত্রী রানী বিশ্বাসকে নিয়ে কোথায় যাবেন, অস্ত্রোপচার করতে হলে কত টাকা খরচ হবে, এসব ভেবেই দিন কাটছিল তার।
কথা প্রসঙ্গে পুবাইলের তালটিয়া এলাকার করমতলা খ্রিষ্টান হাসপাতাল সম্পর্কে তাকে জানান এক প্রতিবেশী। সব শুনে আর দেরি করেননি তপন।
ভর্তির পর স্বাভাবিক প্রসবে (নরমাল ডেলিভারি) সন্তান জন্ম দেন রানী। দুই দিন পর নবজাতক ও তার মাকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন তপন।
তপন বিশ্বাস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মহামারির কারণে তিন মাস ধরে অনেক কষ্টে দিন কাটছিল। অভাব-অনটনের কারণে প্রসূতিকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম। এর মধ্যেই করমতলা হাসপাতালের খবর পাই। সেখানে সন্তান প্রসব ও চিকিৎসা বাবদ আমার খরচ হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৫০০ টাকা।’
তপনের মতো আরও অনেক নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের চিকিৎসাসেবায় ভরসা হয়ে উঠেছে করমতলা খ্রিষ্টান হাসপাতাল। যেখানে নামমাত্র খরচে মিলছে উন্নত চিকিৎসা।
শুরুর গল্প
২ দশমিক ১ একর জায়গার ওপর করমতলা হাসপাতালের যাত্রা শুরু ১৯৯২ সালে। টঙ্গীর মাজুখান বাজার থেকে এক কিলোমিটারের একটু বেশি দূরে এর অবস্থান। মূল সড়ক থেকে ৫০ মিটার ভেতরে হাসপাতাল চত্বরে শুরুতে ছোট পরিসরে চালু হয় বহির্বিভাগ, ল্যাব ও ফার্মেসি। ধীরে ধীরে বাড়ে সেবার পরিধি।
এখন একই ছাদের নিচে মিলছে মেডিসিন, সার্জারি, অর্থোপেডিক, এক্স-রে, আল্ট্রাসনোগ্রাম, দন্ত, চক্ষুসহ নানান ধরনের সেবা। রোগীদের জন্য ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকছে জরুরি বিভাগ।
৫০ শয্যার এই হাসপাতালে সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছাড়া বহির্বিভাগে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত রোগী দেখা হয়। প্রতিদিন কয়েক শ রোগী শুধু বহির্বিভাগ থেকে সেবা নেন।
চিকিৎসকের সাক্ষাৎ পেতে কাউন্টার থেকে ৬০ টাকা দিয়ে টিকিট সংগ্রহ করতে হবে সেবাপ্রার্থীকে। তবে প্রথমবার এই খরচের সঙ্গে রোগীকে রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ গুনতে হবে বাড়তি ১০ টাকা।
নরসিংদীর বেলাবো থেকে করমতলায় এসেছেন নাফিসা বেগম। তিনি বলেন, ‘এখানে খরচ অনেক কম, সেবার মান অনেক ভালো। পরিবেশ অন্যান্য হাসপাতালের চেয়ে উন্নত। ৭ বছর ধরে এই হাসপাতলে আমি এবং আমার বাড়ির আশপাশের সবাই ডাক্তার দেখাই। আমার পরিবারের ১০ জনের সফল ডেলিভারি হয়েছে এই হাসপাতালে।’
পুবাইলের মীরের বাজার এলাকার ষাটোর্ধ্ব আব্দুল গফফার বলেন, ‘চোখের যন্ত্রণায় ভুগছিলাম। বিভিন্ন স্থানে অনেক টাকাপয়সা খরচ করে কোনো লাভ হয়নি। বছর দুই আগে এখান থেকে চিকিৎসা নিই। এখন অনেক ভালো আছি।’
খরচ যেমন
করমতলা হাসপাতালে ২৩ বছর ধরে কাজ করছেন রুপার্ট সরকার। বর্তমানে তিনি আছেন অ্যাডমিন অ্যান্ড ফাইন্যান্স অফিসার হিসেবে। নিউজবাংলার কাছে প্রতিষ্ঠানের আদ্যোপান্ত তুলে ধরেন তিনি।
রুপার্ট জানান, প্রেসবিটারিয়ান ফেলোশিপ ইন বাংলাদেশ (পিএফবি) নামের এনজিওর হেলথ প্রজেক্টের অধীনে চলছে এই হাসপাতালের কার্যক্রম। নিজস্ব আয় এবং অনুদান থেকে মেটানো হয় এর পরিচালন ব্যয়। ১০ জন নিজস্ব চিকিৎসক পর্যায়ক্রমে ২৪ ঘণ্টা সেবা দেন।
৬০ টাকায় এখানে কী সেবা পাওয়া যায়, এমন প্রশ্নে রুপার্ট জানান, এই টাকা খরচ করে যে কেউ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ পাবেন। ডাক্তার যদি তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরামর্শ দেন, তা এখানে করানো যাবে স্বল্পমূল্যে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষার মূল্যতালিকা তুলে ধরে রুপার্ট জানান, এখানে ৪৫ থেকে ৫০ ধরনের পরীক্ষা করা হয় মাত্র ৮০ থেকে ৫০০ টাকায়। ৩০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকার মধ্যে করা যায় ৪০ থেকে ৫০ ধরনের এক্স-রে। এর বাইরে প্রতিবার ফিজিওথেরাপি নিতে লাগবে ২০০ টাকা।
এখানে কী কী অপরাশেন হয়, এমন প্রশ্নে রুপার্ট জানান, হার্টের মতো বড় অপারেশন ছাড়া সব ধরনের জেনারেল অপারেশন করা হয়। এসব অপারেশনে খরচ ৮ থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে। চোখের ছানি অপারেশন করাতে খরচ হবে ৩ থেকে ৮ হাজার টাকা। আর ফ্যাকো সার্জারি হয় ১২ থেকে ৩০ হাজার টাকায়।
আর্থিক অসংগতির কারণে যদি কোনো রোগী নির্ধারিত সেবামূল্য দিতে না পারেন, তবে তাকে বিশেষ ছাড় দেয়া হয়। এই ছাড়ের হার সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ বলেও জানান রুপার্ট।
হাসপাতালের অনুমোদন পেতে অপেক্ষা
অনুদান ও নিজস্ব আয়ের ওপর নির্ভরতা কমাতে এবং আরও কম খরচে ভালো মানের সেবা নিশ্চিত করতে চায় এই সেবাপ্রতিষ্ঠান। এ জন্য সরকারি নিবন্ধন পেতে আবেদন করা হয়েছে। গেল বছরের ১০ ডিসেম্বর অনলাইনে এই আবেদন করা হলেও এখনও সাড়া মেলেনি।
অ্যাডমিন অ্যান্ড ফাইন্যান্স অফিসার রুপার্ট বলেন, ‘১০ শয্যার হাসপাতালের অনুমোদন পেতে আবেদন করা হয়েছে। নাম প্রস্তাব করা হয়েছে সিএইচডিপিকে জেনারেল হাসপাতাল। অনুমোদনের জন্য অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি অন্য যেসব শর্ত পূরণ করতে হয়, তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আমরা আশা করছি, খুব শিগগির একটা ভালো রেজাল্ট পাব।’
পরিচালকের বক্তব্য
কোরিয়ান নাগরিক সাং নো লি। তিনি এই সেবাপ্রতিষ্ঠানের শুরুর দিকের একজন কর্মকর্তা। বর্তমানে আছেন পরিচালকের দায়িত্বে।
নিউজবাংলাকে সাং নো লি বলেন, শুরুতে এখানে বিনা মূল্য ওষুধ দেয়া হতো। কিন্তু দেখা যেত ওষুধ নিয়ে বাইরে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে। পরে সেবা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হয়। ওষুধ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে রোগীদের জন্য স্বল্পমূল্যে ওষুধ প্রাপ্তি নিশ্চিত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, বিদেশি চিকিৎসকের মাধ্যমে চোখের ফ্যাকো সার্জারি করা হচ্ছে। সুবিধাবঞ্চিত রোগীর পক্ষে এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা করাই সম্ভব না। সেখানে স্বল্পমূল্যে করমতলা হাসপাতাল করে দিচ্ছে।
বেসরকারিভাবে পরিচালিত এই চিকিৎসাকেন্দ্র সরকারি অনুমোদন পেলে সেবার মান ও পরিধি আরও বাড়বে বলে জানান সাং নো লি।
গাজীপুরের সিভিল সার্জন মো. খায়রুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করমতলা হাসপাতালের সেবার মান ভালো। কম খরচে ভালো সেবা পেতে হতদরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের ভরসাস্থল হয়ে উঠেছে হাসপাতালটি।’
সেবা দিয়ে সুনাম কুড়িয়েছে করমতলা উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরকারি নিবন্ধন পেতে করমতলার আবেদন করার বিষয়টি আমি জেনেছি। আশা করছি, সংশ্লিষ্টরা ওই আবেদন যাচাই করে দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন।’