বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো টিকার প্রথম ডোজ নেয়ার দুই মাসের মধ্যেই দ্বিতীয় ডোজ নিলে সুরক্ষা ও প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি মিলবে। কিন্তু বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যত লোককে সিরামের তৈরি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেয়া হয়েছে তাদের সবাই দুই মাসের মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ নিতে পারেননি টিকা সংকটের কারণে। প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ লোক অপেক্ষায় আছেন এই টিকার।
এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, সিরামের টিকার প্রথম ডোজ নিয়ে যে সাড়ে ১৩ লাখ মানুষ অপেক্ষায় আছেন তারা কী করবেন? তারা কি দ্বিতীয় ডোজে অন্য কোনো কোম্পানির টিকা গ্রহণ করবেন? নাকি সিরামের জন্যই অপেক্ষায় থাকবেন?
বিষয়টি নিয়ে নিউজবাংলা কথা বলেছে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে। তারা বলছেন, মোটা দাগে সব টিকারই একই ধরনের কার্যকারিতা আছে। এ ক্ষেত্রে উদ্বিগ্ন না হয়ে, সিরামের টিকার জন্য অপেক্ষা না করে যে টিকা পাওয়া যায় তাই নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। তবে সরকারের তরফ থেকে এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
সরকার চাইছে দেশের ৮০ শতাংশ জনগণকে টিকার আওতায় আনতে। এ হিসাবে অন্তত সাড়ে ১৩ কোটি লোককে টিকা দিতে হলে প্রয়োজন ২৭ কোটি ডোজ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে করোনাভাইরাসের টিকাদান কর্মসূচি শুরুর পর ৭ জুন সোমবার পর্যন্ত দেয়া হয়েছে ১ কোটি ৪৩ হাজার ১৯৩ ডোজ, যার প্রায় সবই সিরামের। এর মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ৪২ লাখ ২৩ হাজার ১৭৮ জন। বিভিন্ন কারণে টিকা নষ্ট হয়েছে ৯০ হাজার ৪১৮ ডোজ। সরকারের কাছে সিরামের টিকার মজুত রয়েছে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৩৮৯ ডোজ, যা দিয়ে কয়েক দিন চলবে টিকা কার্যক্রম।
যুক্তরাজ্যের মালিকানাধীন সিরামের টিকা আসা স্থগিত থাকলেও দেশে এসেছে চীনের সিনোফার্মার ৫ লাখ ডোজ, যে টিকার প্রয়োগ শুরু হয়েছে গত ২৫ মে। তবে তা শুধু মেডিক্যালের শিক্ষার্থীদের দেয়া হচ্ছে। ৭ জুন সোমবার পর্যন্ত এই টিকার দুই হাজার ডোজ দেয়া হয়েছে।
বৈশ্বিক টিকা বণ্টনের জোট কোভ্যাক্স থেকে আসা ফাইজারের ১ লাখ ৬২০ ডোজ রয়েছে অব্যবহৃত অবস্থায়। কবে নাগাদ এই টিকা প্রয়োগ শুরু হবে তা সোমবার পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সিরামের মোট টিকা এসেছে ১ কোটি ৩ লাখ ডোজ। চীন থেকে উপহার হিসেবে এসেছে সিনোফার্মার ৫ লাখ টিকা। ১৩ জুন আসার কথা উপহারের আরও ৬ লাখ ডোজ। এর মাঝে ফাইজারের ১ লাখ ৬২০ ডোজ এসেছে গত ১ জুন। রাশিয়ার স্পুৎনিক-ফাইভ টিকার ৫০ লাখ ডোজের কেনার আলোচনা চলছে। এর বাইরে চীন ও রাশিয়া থেকে দেড় কোটি ডোজ করে কিনতে চায় সরকার।
প্রথম ডোজে সিরামের টিকা নেন রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আদাবর এলাকায় বসবাসরত অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা নায়ীমূল কাদির। গত এপ্রিলের শুরুতেই তিনি প্রথম ডোজ নেন। কিন্তু দুই মাস পরও তার কাছে দ্বিতীয় ডোজের জন্য এসএমএস আসেনি। ৭৮ বছর বয়সী এই নাগরিক এখন দিন গুনছেন, সেই এসএমএসের জন্য।
করোনার টিকার দ্বিতীয় ডোজ নিয়ে উদ্বেগ-অনিশ্চয়তায় থাকা এই প্রবীণ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার স্ত্রী গত বছর করোনায় আক্রান্ত হয়েছিল। আমি জানি, এই রোগের যন্ত্রণা কী। তাই আমি দ্রুত টিকা নিতে চেয়েছিলাম। প্রথম ডোজ নিয়ে বসে আছি।
‘কিন্তু দ্বিতীয় ডোজের কোনো খবর নেই। কত দিন পরে পাব তাও জানি না। আর এই দ্বিতীয় ডোজ না নিলে কী হবে তাও বুঝতে পারছি না। সরকারের পক্ষ থেকেও বিষয়টি পরিষ্কার করা হচ্ছে না। পুরোটাই অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি।’
দ্বিতীয় ডোজ নিয়ে এই নায়ীমূল কাদিরের মতো অনিশ্চয়তায় আছেন বেসরকারি একটি ব্যাংকের ম্যানেজার সাজিয়া আফরিন। প্রতিদিন অফিস করতে বাইরে বের হতে হয় তার। তাই দুই মাস আগে করোনার টিকার প্রথম ডোজ নিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু তারপর আট সপ্তাহ পার হলেও দ্বিতীয় ডোজের এসএমএসই পাননি।
‘এখন আমার দ্বিতীয় ডোজ টিকার কী হবে জানি না। আর কত দিন অপেক্ষা করব- সেটাও বুঝতে পারছি না। কত দিন পর দ্বিতীয় ডোজ নিলে টিকা কর্যকর থাকবে তাও তো জানি না’, বলেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু নায়ীমূল কাদির আর সাজিয়া আফরিনই নন, তাদের মতো সাড়ে ১৩ লাখ নাগরিক অপেক্ষায় আছেন অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার। তবে এই অপেক্ষা কতটা দীর্ঘ হবে তা বলা যাচ্ছে না।
কারণ হিসেবে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ভারতে করোনার ব্যাপক বিস্তার আর যুক্তরাষ্ট্র কাঁচামাল দেয়া বন্ধ করে দেয়ায় উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটায় ভারত সরকার টিকা রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়। এ কারণে বাংলাদেশের জন্য প্রস্তুত অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার চুক্তি অনুযায়ী টিকা দিতে পারেনি সিরাম।
নাগরিকদের উদ্বেগের প্রসঙ্গে নিউজবাংলা কথা বলেছে করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলামের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘এখন যেহেতু সিরামের টিকা পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে, এক ডোজ টিকা নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে ঘরে বসে না থেকে চীনের সিনোফার্মের টিকা দেয়া ভালো। কারণ, এই দুই টিকাই মানুষের শরীরে প্রায় একই ধরনের অ্যান্টিবডি তৈরি করে।’
এই ভাইরোলজিস্ট বলেন, ‘চীনের সিনোফার্মের ভ্যাকসিন হলো ইনঅ্যাকটিভেটেড ভ্যাকসিন। আর অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা হচ্ছে ডিএনএ ভাইরাস ক্যারিয়ার ভ্যাকসিন। আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য হলো, করোনা ভাইরাসের স্পাইক প্রটিনের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করা।
‘আশার কথা হলো, অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা এবং চায়নিজ টিকা- দুটোই করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রটিনের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে। তাই চায়নিজ ভ্যাকসিন দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে দিলে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা না।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম বলেন, ‘যেহেতু অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা পাওয়া যাচ্ছে না, তাই একটা টিকা দিয়ে আতঙ্কিত হয়ে বসে না থেকে চীনের টিকা দেয়া ভালো। কারণ এই দুই টিকাই মানুষের শরীরে প্রায় একই ধরনের অ্যান্টিবডি তৈরি করে।’
এ প্রসঙ্গে বিএসএমএমইউর ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডাক্তার সায়েদুল রহমান খসরু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যুক্তরাজ্য ১২ সপ্তাহ ব্যবধানে দ্বিতীয় ডোজ দিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশে প্রথমে মানুষ টিকা নিচ্ছিল না। তাই আট সপ্তাহ ব্যবধানে দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার নিয়ম করা হয়েছিল।
‘আবার কানাডা ১৬ সপ্তাহ ব্যবধানে দ্বিতীয় ডোজ দিয়েছিল, যাতে বেশি মানুষকে প্রথম ডোজ দেয়া যায়। বেসিক্যালি টিকা ১২ সপ্তাহ কার্যকর। মূল কথা হলো- এইসব ভ্যাকসিনের বয়স ৬ মাসের বেশি হয়নি। তাই এগুলো নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা হয়নি। এখন বিশ্বে যে সময় ব্যবধানে টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হচ্ছে, সেটা গবেষণা করে দেয়া হচ্ছে না। ক্যালকুলেশন করে দেয়া হচ্ছে। তাই এখনই বলা যাচ্ছে না, কত সপ্তাহ ব্যবধানে টিকার দ্বিতীয় ডোজ নেয়া উচিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু আমরা সিরামের টিকা আপাতত পাচ্ছি না, তাই আমি মনে করি বসে না থেকে আমরা অন্য টিকা দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে নিতে পারি। কারণ আমরা দেখেছি, বিশ্বের কয়েকটি দেশ প্রথম ডোজ হিসেবে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ব্যবহার করে দ্বিতীয় ডোজে ফাইজার ও স্পুৎনিক-ফাইভের টিকাও দিচ্ছে।’