ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা মিউকরমাইকোসিস নিয়ে অহেতুক ভয় পাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই বলে মন্তব্য করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে এ রোগ প্রতিরোধযোগ্য বলে আশ্বস্ত করে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা সম্পর্কে তিনি বলেন, হাসপাতালে ভর্তি করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে থেকে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা আবশ্যক। সময় নষ্ট না করে চিকিৎসা শুরু করতে হবে।
বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডা. মিল্টন হলে ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা বিষয়ক গাইডলাইনের প্রকাশনা’ উপলক্ষে বিশেষ সংবাদ সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ছত্রাকবিরোধী ওষুধ বা অ্যান্টিফাঙ্গাল ড্রাগ জরুরিভাবে প্রয়োগ করতে হবে। পাশিপাশি ঝুঁকিসমূহ যেমন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করতে হবে। প্রয়োজনে আক্রান্ত অঙ্গে সার্জারি করতে হতে পারে বা কোনো কোনো সময়ে তা কেটে ফেলে দিয়ে জীবন রক্ষা করতে হতে পারে।
‘সার্জারিগুলোর মধ্যে রাইনো-অরবিটাল-সেরেব্রাল সংক্রমণে নাক, সাইনাস বা চক্ষুকোটরের অপারেশন, আক্রান্ত অংশ অপসারণ, চক্ষু অপসারণ, এক্সেন্টারেশন ও ইন্ট্রাক্র্যানিয়াল অন্যতম।’
ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, কোভিড মহামারির সঙ্গে ভারতের ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের প্রাদুর্ভাবের সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশে কয়েকজন রোগী পাওয়া গেলেও এই মুহূর্তে ভারতের মতো মহামারির আশঙ্কা নেই।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন সব চিকিৎসক, নার্স ও কর্মীদের নিয়ে কোভিড-১৯-এর মোকাবিলায় বিশেষ করে দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে।
‘আইসিইউ ও বেডসংখ্যা কয়েক গুণ বাড়িয়ে, হাইফ্লো অক্সিজেনের সরবরাহ সম্প্রসারিত করে ও পূর্ণ উদ্যমে ভ্যাক্সিনেশনের মাধ্যমে কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে। ব্ল্যাক ফাঙ্গাস নিয়েও সরকার, চিকিৎসক সমাজ, সাংবাদিক ও জনগণকে সঠিক ধারণা ও করণীয় সম্পর্কে সচেতন করতে আজ এই গাইডলাইন প্রকাশ করা হল।’
তিনি বলেন, মিউকরমাইকোসিস বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বিশেষ ধরনের অণুবীক্ষণিক ছত্রাকের সংক্রমণজনিত বিভিন্ন রোগকে বোঝায়। এর মধ্যে রাইজোপাস প্রজাতি হলো সবচাইতে বেশি দায়ী, তবে অন্যান্য জীবাণু যেমন মিউকর, কানিংহামেলা, অ্যাফোফিজোমাইসেস, লিচথিমিয়া, সাকসেনিয়া, রাইজোমুকর এবং অন্যান্য প্রজাতিও এই রোগের কারণ।
‘এই ছত্রাক সর্বব্যাপী- মাটি, পানি ও বাতাসে ছড়িয়ে থাকলেও সংক্রমণক্ষমতা এতই কম যে এক লাখ মানুষের মধ্যে মাত্র ১-২ জন আক্রান্ত হতে পারে। এটা বেড়ে সর্বোচ্চ এক লাখে ২০-৩০ জন হতে পারে। এই রোগ ছোঁয়াচে নয়।’
বহু আগে থেকেই এই রোগের কথা জানা থাকলেও সম্প্রতি কোভিড মহামারিতে ভারতে এর প্রকোপ দেখা যায়। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, বিশেষত কিটো অ্যাসিডোসিস আক্রান্ত রোগীরা, ক্যানসারে আক্রান্ত রোগী, অতিরিক্ত বা অপ্রয়োজনীয় ব্রড-স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার, অন্তঃসত্ত্বা নারী, অত্যধিক মাত্রায় বা অপ্রয়োজনীয় স্টেরয়েড গ্রহণ করা, কিডনি বা অন্য অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা রোগী এবং চরম অপুষ্টিজনিত রোগী, চামড়ার গভীর ক্ষত ও পোড়া ঘায়েও এই রোগ হতে দেখা যায়। কোভিড ভাইরাসে দীর্ঘমেয়াদে আক্রান্ত বা চিকিৎসাধীন রোগী এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।
তিনি আরও বলেন, মিউকর ছত্রাকের হাইফাগুলো মানুষের রক্তনালিতে আক্রমণ করে, যা থেকে থ্রম্বোসিস ও টিস্যু ইনফেকশন, নেক্রোসিস এবং পরিশেষে গ্যাংগ্রিনও হতে পারে। সুস্থ মানুষের রক্তের শ্বেত রক্তকণিকা বা নিউট্রোফিল এই ছত্রাকের বিরুদ্ধে মূল প্রতিরক্ষার কাজ করে থাকে। সুতরাং নিউট্রোপেনিয়া বা নিউট্রোফিল কর্মহীনতায় (যেমন, ডায়াবেটিস, স্টেরয়েড ব্যবহার) বা এইডস আক্রান্ত ব্যক্তিরা সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকেন।
‘আক্রান্ত অঙ্গের ওপর ভিত্তি করে মিউকরমাইকোসিস রোগটি ছয় ধরনের হলেও রাইনো-অরবিটাল-সেরেব্রাল রোগ নাক, নাকের ও কপালের সাইনাস, চোখ ও ব্রেইন বা মস্তিষ্কে সংক্রমণ করে বলে এটাই সবচাইতে বিপজ্জনক। তাছাড়া ফুসফুসীয়, আন্ত্রিক, ত্বকীয় সংক্রমণও হতে পারে।’
‘আক্রান্ত অংশ আর নাকের শ্লেষ্মা, কফ, চামড়া ও চোখ কালো রং ধারণ করে বলে একে কালো ছত্রাক নামে ডাকা হয়। আক্রান্ত রোগীদের দ্রুত এবং সঠিক চিকিৎসা না করতে পারলে ৫০ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ রোগী মৃত্যুবরণ করে থাকেন। আর সংক্রমণের মৃত্যুর হার ১০০ শতাংশের কাছাকাছি।’
এ ছাড়া মঙ্গলবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে করোনাসংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি ফাঙ্গাসজনিত সংক্রমণ প্ৰতিরোধে চিকিৎসা গাইডলাইন তৈরি ও ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের চিকিৎসা অন্তর্ভুক্তকরণ, প্রয়োজনীয় ওষুধ সংরক্ষণ এবং স্টেরয়েডের যৌক্তিক ব্যবহারের সুপারিশ করেছে।
সংবাদ সম্মেলনে উপ-উপাচার্য মুহাম্মদ রফিকুল আলম প্রশাসন, উপ-উপাচার্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মো. জাহিদ হোসেন, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান, বেসিক সায়েন্স অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. খন্দকার মানজারে শামীম, মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. মাসুদা বেগম, প্রক্টর অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুর রহমান দুলাল, রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল হান্নান, আইআরবি’র সদস্যসচিব সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. রসুল আমিন ছাড়াও আইআরবি’র সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।