চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় মিউকরমাইকোসিস বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাস (কালো ছত্রাক) বিরল রোগ হলেও রোগটিতে আক্রান্তদের মৃত্যুহার ৫০ শতাংশের বেশি। বিশেষ করে ডায়াবেটিস, ক্যানসার, এইডসসহ বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় আক্রান্তরা এ রোগে আক্রান্ত হলে মৃত্যু প্রায় অবধারিত।
যারা প্রাণে বেঁচে যান, তাদেরও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে এক বা দুই চোখ, এমনকি চোয়ালও ফেলে দিয়ে বাঁচতে হয় বাকি জীবন।
এবিসি নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শীত ও বসন্তের তুলনায় গ্রীষ্ম ও শরৎকালে মিউকরমাইকোসিসের সংক্রমণ বেশি হয়ে থাকে।
রোগটির চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এর বিরুদ্ধে কার্যকর একমাত্র ওষুধ শিরায় প্রদেয় একটি ইনজেকশন। এর একেকটির দাম প্রায় ৪৮ ডলার। রোগীকে টানা আট সপ্তাহ প্রতিদিন নিতে হয় এ ইনজেকশন।
তাই মিউকরমাইকোসিস বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাস থেকে বাঁচতে সচেতনতা ও সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই।
এ জন্য আগে জানা দরকার, ব্ল্যাক ফাঙ্গাস কেন হয় এবং ঝুঁকি কাদের বেশি।
মিউকরমাইকোসিস কী
বিরল মিউকরমাইকোসিসের কারণ ‘মিউকর মোল্ড’ জাতীয় একধরনের শ্লেষ্মার সংস্পর্শে আসা। এই শ্লেষ্মার দেখা মেলে মূলত মাটি, গাছ, সার, পচে যাওয়া ফল-সবজিতে, যা সবকিছুতেই ছড়াতে পারে। মাটি ও বাতাসের মাধ্যমে নাক হয়ে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মানুষকেও আক্রান্ত করতে পারে এটি।
শ্বাসতন্ত্র অথবা ত্বকের মাধ্যমে একবার এটি মানবদেহে প্রবেশ করলে এরপর এই ছত্রাক মুখমণ্ডলজুড়ে ছড়াতে শুরু করে। প্রথমে নাক, কপাল ও গালের পেছন আর দুই চোখের মাঝখানে অবস্থিত সাইনাস বা ‘এয়ার পকেট’, তারপর ত্বক, মস্তিষ্ক, ফুসফুস আর কিডনিতেও ছড়ায় এই ছত্রাক।
একেক করে সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হতে থাকে এর সংক্রমণে।
ঝুঁকিতে কারা
মিউকরমাইকোসিসের কেন্দ্রে পরিণত হওয়া ভারতে করোনা রোগীদের মধ্যে যাদের ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত কিংবা স্টেরয়েড প্রয়োগে শরীরের প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে গেছে, হাসপাতাল বা আইসিইউতে দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়েছেন কিংবা ছত্রাকের গুরুতর সংক্রমণের চিকিৎসা হিসেবে ভোরিকোনাজল থেরাপি নিয়েছেন, তারাই আক্রান্ত হচ্ছেন মিউকরমাইকোসিসে।
যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (সিডিসি) তথ্য অনুযায়ী, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অর্থাৎ করোনাভাইরাস মহামারির আগে বিশ্বে প্রতি ১০ লাখ মানুষে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্তের সংখ্যা ১ দশমিক ৭ ছিল।
অথচ শুধু ভারতে গত এক মাসে কমপক্ষে ৯ হাজার মানুষের দেহে রোগটি শনাক্ত হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। প্রত্যেকেই করোনাভাইরাস থেকে সেরে উঠেছিলেন।
বাংলাদেশেও কমপক্ষে দুইজনের দেহে রোগটি শনাক্ত হয়েছে।
সাধারণ অবস্থাতেও ডায়াবেটিস, ক্যানসার, অঙ্গ প্রতিস্থাপন, কোষ প্রতিস্থাপন, রক্তে অতিরিক্ত আয়রন, ত্বকে পুড়ে যাওয়া বা কোনো আঘাত বা অস্ত্রোপচার থেকে সৃষ্ট ক্ষত ইত্যাদিতে ভুগছেন, এমন রোগীদের ক্ষেত্রে এ রোগের ঝুঁকি বেশি।
রোগীর করণীয়
বেশির ভাগ মানুষ এই ছত্রাকের সংস্পর্শে এলেও তাদের আক্রান্ত করতে পারে না এটি; বরং অত্যধিক দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিরল এ রোগটিতে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ। তাই রোগের সংক্রমণ এড়াতে ব্যক্তির খুব বেশি কিছু করার নেই।
বরং উপসর্গ দেখা দিয়েছে বলে মনে হলেই তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
ছত্রাক কোথায় ছড়াচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে এ রোগের উপসর্গ। সাধারণ লক্ষণ হচ্ছে সর্দি, নাক বন্ধ থাকা ও নাক থেকে রক্ত পড়া।
ধীরে ধীরে চোখ ফুলে ওঠে, চোখে তীব্র ব্যথা শুরু হয়, চোখের পাতা ঝুলে পড়ে। দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হতে হতে শেষ পর্যন্ত চলেই যায়।
অনেক সময় নাকের আশপাশের ত্বকে আর মুখের ভেতরের উপরিভাগে কালো দাগও দেখা যায়।
এ ছাড়াও এ রোগে মুখ ফুলে ওঠা, মাথাব্যথা, তলপেটে ব্যথা, বমিভাব ও বমি, পেটের ভেতরে রক্তক্ষরণ ইত্যাদি হতে পারে।
তবে চিকিৎসার জন্য এত সব উপসর্গ দেখা দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলে অঙ্গহারা হতে পারেন রোগী, হতে পারে মৃত্যুও।
সাধারণত সব বয়সী মানুষের এই ছত্রাকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি না থাকলেও ভারতে মহামারিকালীন রোগটিতে ২৫ বছর বয়সের তরুণীর মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
এমন পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাস মহামারিতে প্রাণহানি তিন লাখ ছাড়ানো ভারতে নতুন আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস। করোনা মহামারির দ্বিতীয় ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই ব্ল্যাক ফাঙ্গাস মহামারি ঘোষণা করেছে বিভিন্ন রাজ্য।