করোনাভাইরাস মহামারির দ্বিতীয় ধাক্কার মধ্যেই নতুন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ভারত। ভাইরাস থেকে সেরে ওঠা রোগীদের মধ্যে বাড়ছে প্রাণঘাতী কালো ছত্রাকের সংক্রমণ। অবস্থার ভয়াবহতায় বিভিন্ন রাজ্যে নেয়া হচ্ছে জরুরি ব্যবস্থা।
টাইমস অফ ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, বৃহস্পতিবার তামিলনাড়ু, গুজরাট, ওড়িশা ও চন্ডিগড়ে মিউকরমাইকোসিস মহামারি ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকারগুলো।
এর আগে মহামারি রোগ আইন ১৮৯৭ অনুযায়ী সতর্কতামূলক রোগ বিবেচনায় সব রাজ্য ও স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলকে কালো ছত্রাক মহামারি পরিস্থিতি জারির আহ্বান জানায় কেন্দ্রীয় সরকার।
একই সঙ্গে রাজ্য ও স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলগুলোর সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালকে কালো ছত্রাকের সব সন্দেহভাজন ও নিশ্চিত রোগীর তথ্য কেন্দ্রীয় সরকারকে জানানোর নির্দেশও দেয়া হয়েছে।
ভারতে করোনাভাইরাস থেকে সেরে ওঠা রোগীদের মধ্যে কালো ছত্রাক সংক্রমণের প্রবণতা সম্প্রতি প্রথম জানায় মহারাষ্ট্র। এরপর গত এক মাসে কর্ণাটক, উত্তরাখণ্ড, তেলেঙ্গানা, মধ্য প্রদেশ, অন্ধ্র প্রদেশ, হরিয়ানা, বিহারসহ বিভিন্ন রাজ্য থেকে একই খবর আসতে থাকে কেন্দ্রের কাছে।
মহারাষ্ট্রে এ পর্যন্ত মিউকরমাইকোসিসে আক্রান্ত হয়েছেন দেড় হাজারের বেশি রোগী, যাদের ৯০ জনই মারা গেছেন। বাকিদের বেশিরভাগই বেঁচে গেলেও হারিয়েছেন এক বা দুটি চোখই। জীবন বাঁচাতে অনেকের চোয়ালও অস্ত্রোপচার করে ফেলে দিতে হয়েছে। এদের সবাই করোনাভাইরাস থেকে সেরে উঠেছিলেন।
বৃহস্পতিবার পর্যন্ত হরিয়ানা এ ধরনের ২২৬ রোগী এবং তেলেঙ্গানা ৯০ জনের মিউকরমাইকোসিসের তথ্য নিশ্চিত করেছে। গুজরাট আর মধ্য প্রদেশেও বাড়ছে এ সংখ্যা।
রোগের ব্যাপকতায় চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধেরও ঘাটতি দেখা দিয়েছে অনেক জায়গায়।
মিউকরমাইকোসিস বা কালো ছত্রাকের সংক্রমণ কী
মিউকরমাইকোসিস খুবই বিরল একটি রোগ। সাধারণত ‘মিউকর মোল্ড’ জাতীয় এক ধরনের শ্লেষ্মার সংস্পর্শে এলে রোগটি হয়।
এই শ্লেষ্মার দেখা মেলে মূলত মাটি, গাছ, সার, পচে যাওয়া ফল-সবজিতে, যা সবকিছুতেই ছড়াতে পারে। মাটি ও বাতাসের মাধ্যমে নাক হয়ে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মানুষকেও আক্রান্ত করতে পারে এটি।
নাক, কপাল ও গালের পেছন আর দুই চোখের মাঝখানে অবস্থিত সাইনাস বা ‘এয়ার পকেট’, মস্তিষ্ক ও ফুসফুসে ছড়ায় এটি। ডায়াবেটিস, ক্যানসার ও এইডসে আক্রান্ত বা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুব দুর্বল, এমন ব্যক্তিদের জন্য প্রাণঘাতীও হতে পারে এই মিউকরমাইকোসিস।
বিরল এ রোগে আক্রান্তদের মৃত্যুহার ৫০ শতাংশের বেশি।
ভারতে মিউকরমাইকোসিসের ব্যাপকতা
গত ৯ মে বিবিসিতে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। সেখান থেকে জানা যায়, ভারতে করোনাভাইরাসের অন্যতম কেন্দ্রস্থল মুম্বাইয়ের তিনটি হাসপাতালে সেবা দিচ্ছেন ড. নায়ার। তিনি এপ্রিল থেকে মিউকরমাইকোসিসে আক্রান্ত কমপক্ষে ৪০ জন রোগী পেয়েছেন, যাদের ১১ জনের চোখই ফেলে দিতে হয়েছে অস্ত্রোপচার করে।
এর আগে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মুম্বাই, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, দিল্লি ও পুনেতে তার ছয় সহকর্মী মিউকরমাইকোসিসের ৫৮ জন রোগী পেয়েছেন। এদের বেশিরভাগই করোনা নেগেটিভ হওয়ার ১২ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে মিউকরমাইকোসিসে আক্রান্ত হয়েছেন।
জবলপুরের একটি সরকারি হাসপাতালে কালো ছত্রাকে আক্রান্ত এক রোগী। ছবি: এএফপি
গত দুই মাসে মুম্বাইয়ের সিয়ন হাসপাতালে এ ধরনের ২৪ জন রোগী এসেছেন বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির নাক-কান-গলা বিভাগের প্রধান ড. রেনুকা ব্রাদু। এদের মধ্যে ছয়জন মারা গেছেন এবং ১১ জনের চোখ ফেলে দিতে হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এই রোগীদের বেশিরভাগই মধ্যবয়স্ক এবং করোনা থেকে সেরে ওঠার দুই সপ্তাহের মধ্যে তারা মিউকরমাইকোসিসে আক্রান্ত হয়েছেন। প্রতি সপ্তাহে এমন দুই-তিনজন করে রোগী পাচ্ছি আমরা। মহামারির এই দুঃসময়ে নতুন দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে এই রোগ।’
দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর বেঙ্গালুরুর চক্ষু বিশেষজ্ঞ ড. রঘুরাজ হেগড়ে জানান, গত দুই সপ্তাহে মিউকরমাইকোসিসের ১৯ জন রোগী দেখেছেন তিনি। সবাই বয়সে তরুণ। অনেকে এতই অসুস্থ ছিলেন যে তাদের অস্ত্রোপচার করাও সম্ভব হয়নি।
তিনি বলেন, ‘গত মাসে মিউকরমাইকোসিসের সবচেয়ে কম বয়সী রোগী পেয়েছি আমি। মাত্র ২৭ বছর বয়স তার। ডায়াবেটিসও ছিল না। পরের সপ্তাহেই তার চোখ ফেলে দিতে হয়েছে। পুরো বিষয়টি ভীষণ হতাশাজনক।’
মহামারির দ্বিতীয় ধাক্কা চলমান থাকার মধ্যেই ছত্রাক সংক্রমণের ভয়াবহতায় বিস্মিত চিকিৎসকরা। গত বছর প্রথম ধাক্কাতেও মিউকরমাইকোসিসের এমন ব্যাপকতা ছিল না।
ড. নায়ার জানান, এর আগে গত দুই বছরে মিউকরমাইকোসিসের ১০ জন রোগীও পাননি।
তিনি বলেন, ‘এ বছরটি সত্যিই অন্যরকম।’
১০ বছরের বেশি সময় ধরে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করা ড. হেগড়ে জানান, এর আগে বছরে গড়ে সর্বোচ্চ এক বা দুইজন মিউকরমাইকোসিসের রোগী পেতেন তিনি।
করোনার সঙ্গে মিউকরমাইকোসিসের সম্পর্ক কী
চিকিৎসকরা বলছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণে গুরুতর অসুস্থ রোগীদের প্রাণ বাঁচাতে স্টেরয়েডের ব্যবহারের ফলে মিউকরমাইকোসিসে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে।
মানবদেহে প্রাকৃতিকভাবে যেসব হরমোন নিঃসরণ হয়, সেগুলোর মানবসৃষ্ট সংস্করণ হলো স্টেরয়েড।
করোনাভাইরাসের কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা বা ওষুধ এখন পর্যন্ত উদ্ভাবন হয়নি। এতে গুরুতর অসুস্থ হচ্ছে যারা, তাদের ফুসফুসে প্রদাহ কমাতে নানা ধরনের রাসায়নিকের সমন্বয়ে তৈরি স্টেরয়েড ব্যবহার করছেন চিকিৎসকরা।
করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহারের ফলে নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, ক্ষতিও কমাতে সহায়ক স্টেরয়েড। কিন্তু একই সঙ্গে এটি দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে ফেলে এবং ডায়াবেটিস আছে বা নেই এমন সব রোগীর রক্তেই শর্করার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।
ধারণা করা হচ্ছে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অত্যধিক দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারণে মিউকরমাইকোসিসের রোগী বাড়ছে। ডায়াবেটিসের কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এমনিতেই কম থাকে, করোনাভাইরাস যা আরও বাড়িয়ে তোলে।
এর ওপর করোনার চিকিৎসায় স্টেরয়েড ব্যবহার করা তা অনেকটা আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করে।
মিউকরমাইকোসিসে আক্রান্ত হচ্ছেন কারা
ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, মূলত করোনায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে আইসিইউতে কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন নিয়েছেন যেসব রোগী, তারাই মিউকরমাইকোসিসে আক্রান্ত হচ্ছেন।
ভারতের একটি হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন এক করোনা রোগী। ছবি: এএফপি
কারণ অক্সিজেন সাপোর্ট দিতে বাতাসে আর্দ্রতা রক্ষায় হিউমিডিফায়ার যন্ত্রের ব্যবহার আবশ্যক। আর অতি আর্দ্রতা ছত্রাক জন্মাতে সাহায্য করে।
করোনা রোগীদের মধ্যে যাদের ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত কিংবা স্টেরয়েড প্রয়োগে শরীরের প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে গেছে, হাসপাতাল বা আইসিইউতে দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়েছেন কিংবা ছত্রাকের গুরুতর সংক্রমণের চিকিৎসা হিসেবে ভোরিকোনাজল থেরাপি নিয়েছেন, তারাই আক্রান্ত হচ্ছেন মিউকরমাইকোসিসে।
মিউকরমাইকোসিসের লক্ষণ
কালো ছত্রাকে আক্রান্ত হওয়ার প্রাথমিক উপসর্গ হলো সর্দি, নাক বন্ধ থাকা ও নাক থেকে রক্ত পড়া। ধীরে ধীরে চোখ ফুলে ওঠে, চোখে তীব্র ব্যথা শুরু হয়, চোখের পাতা ঝুলে পড়ে। দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হতে হতে শেষ পর্যন্ত চলেই যায়। অনেক সময় নাকের আশপাশের ত্বকে কালো দাগও দেখা যায়।
চিকিৎসকরা জানান, বেশিরভাগ রোগীই দেরিতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। ততদিনে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন তারা। তখন মস্তিষ্ক বাঁচাতে চোখ ফেলে দেয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
ভারতের চিকিৎসকরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে রোগীর দুই চোখই ফেলে দিতে হচ্ছে। এমনকি রোগ ছড়ানো বন্ধে কয়েকজন রোগীর চোয়ালের হাড়ও অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ফেলে দিতে হয়েছে।
ব্যয়বহুল চিকিৎসা
কালো ছত্রাকের বিরুদ্ধে কার্যকর একমাত্র ওষুধ শিরায় প্রদেয় একটি ইনজেকশন। এর একেকটির দাম প্রায় ৪৮ ডলার। ভারতীয় মুদ্রায় সাড়ে তিন হাজার রুপি।
রোগীকে টানা আট সপ্তাহ প্রতিদিন নিতে হয় এ ইনজেকশন।
বিরল এ রোগ হঠাৎ বৃদ্ধি পাওয়ায় দেখা দিয়েছে ওষুধের ঘাটতি। সংকট নিরসনে ভারতে নতুন অনেক ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠানকে ওষুধটির অনুমোদন দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে দেশটির সরকার।
বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলো এসব ওষুধের উৎপাদন এর মধ্যেই বাড়িয়েছে বলেও জানানো হয়েছে।