দেশে ছয়জনের দেহে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ার পর করোনা নিয়ে দুশ্চিন্তা আরও গেড়ে বসেছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার ভারতের ভ্যারিয়েন্ট আরও বেশি সংক্রামক। একজন রোগী এক মাসে ৪০৬ জনকে আক্রান্ত করতে পারে, এই তথ্য জানিয়েছে ভারতের দ্য ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর)।
প্রতিবেশী দেশের গবেষণা সংস্থাটির দেয়া তথ্য উদ্বেগজনক ভাবাচ্ছে বাংলাদেশকে। এই ভ্যারিয়েন্ট রোধে সীমান্ত বন্ধের পরও সংক্রমণ ঘটেছে, আর শনাক্ত দুইজন যাননি ভারতেও। অর্থাৎ অন্য কারও মাধ্যমে তাদের এলাকা সাতক্ষীরা ও খুলনায় এসেছে ভাইরাসটি।
এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় যে হাতিয়ার হতে পারত টিকা, সেটিও পর্যাপ্ত নেই সরকারের হাতে। ভারতীয় সেরাম ইনস্টিটিউট টিকা দিতে না পারার পর সরকার চীন ও রাশিয়ামুখী হলেও তাদের টিকা কবে আসবে, সেটি চূড়ান্ত হয়নি এখনও।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সবচেয়ে বেশি শঙ্কিত মানুষের অসচেতনতায়। বারবার সাবধান করা হলেও স্বাস্থ্যবিধির বিষয়টি পাত্তা পাচ্ছে না। ঈদ কেনাকাটা আর বাড়ি ফিরতে মানুষ যে বেপরোয়া মনোভাব দেখাচ্ছে, সেটি করোনার সংক্রমণ ঘটাতে পারে বলেও মনে করছেন তারা।
বিজ্ঞানীদের মতে, কিছু মিউটেশনের কারণে ভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিনে পরিবর্তন ঘটে। মানবদেহের কোষের সঙ্গে নিজেকে আটকে ফেলতে এবং ভেতরে ঢুকতে ভাইরাসটি এই স্পাইক প্রোটিন ব্যবহার করে। ভাইরাসের মধ্যে যখন এ ধরনের মিউটেশন ঘটে, তখন এর সংক্রমণ ঘটানোর ক্ষমতা সম্ভবত বেড়ে যায়। এ ধরনের ভাইরাসে মানুষ বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং এটি প্রতিরোধে টিকা আর কাজ করে না।
ভারতে এ মুহূর্তে করোনার তিনটি ভ্যারিয়েন্ট (B.1.617, B.1.617+S:V382L এবং B.1.618) নিয়ে পর্যালোচনা চলছে। B.1.618 কে বলা হচ্ছে বেঙ্গল ভ্যারিয়েন্ট। ভারতের গবেষকরা দাবি করছেন, গত ৬০ দিনে সে দেশে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ১২ শতাংশ এই বেঙ্গল ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত।
ভারতের করোনা পরিস্থিতি করুণ
ভারতে ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা চার হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এক দিনে এখন শনাক্ত হচ্ছে গড়ে চার লাখের বেশি।
বিশ্বে এক দিনে কোনো দেশে এত বেশি মানুষের করোনা সংক্রমণ এর আগে ঘটেনি।
এমন পরিস্থিতিতে ভেঙে পড়ার উপক্রম হয় ১৩৩ কোটি মানুষের দেশটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, যেটি সন্দেহাতীতভাবেই বাংলাদেশের চেয়ে ভালো।
সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ভারতে প্রতিনিয়ত বাড়তি রোগীর চাপ সামলাতে হচ্ছে হাসপাতালগুলোকে। দেখা দিয়েছে অক্সিজেনের তীব্র সংকট।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত অক্সিজেনস্বল্পতা দেখা দেয়নি। তবে রোগীর সংখ্যা ২৪ ঘণ্টায় সাত হাজার ছাড়িয়ে গেলে অক্সিজেনের চাহিদা পূরণ করা কঠিন হবে বলে জানিয়েছেন খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
করোনার ভারত ভ্যারিয়েন্ট দ্রুত রোগীকে কাবু করে ফেলছে। কোনো ধরনের উপসর্গ প্রকাশের ১০ ঘণ্টার মধ্যেই অক্সিজেনের চাহিদা তৈরি করছে। বিপুল সংখ্যক রোগীকে দিতে হচ্ছে আইসিইউ সাপোর্ট।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা উদ্বিগ্ন মানুষের আচরণে
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এক বছর আগ থেকে বলে আসছি, মাস্ক পরা ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার কথা। কিন্তু কোনো কিছুই বাস্তবায়ন করাতে পারেনি।’
তিনি বলেন, ‘যে কয়েকজন শনাক্ত হয়েছে তাদের যদি ভালোভাবে আইসোলেশনে রাখা হয়, মাস্ক পরানো হয় তাহলে ৯৬ শতাংশ সংক্রমণ এড়ানো সম্ভব। আর যে ৪ শতাংশ মাস্ক ভেদ করে ভাইরাসটি বাইরে আসে তা শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে পারলেই এড়ানো সম্ভব।’
তবে এটি কে বাস্তবায়ন কে করবে- সেই প্রশ্নও করেছেন অধ্যাপক নজরুল।
ঈদে বাড়ি ফেরার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন তো মনে হচ্ছে বাড়ি ফেরার জন্য বাস চলাচল স্বাভাবিক রেখে স্বাস্থ্যবিধি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে ভালো হতো।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, ‘ভারতে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় একটি মানবিক বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। এই কারণে ভারতের সঙ্গে আশপাশের দেশগুলোতেও আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ ভারতের সঙ্গে সব রকম যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা জানি না, এই ভাইরাসটি বাংলাদেশের জন্য কী রোল প্লে করবে। তবে আশঙ্কাটা আমাদের জন্য খুব বেশি।’
তিনি বলেন, ‘যে শত্রুকে চেনা যায় তাকে মোকাবিলা করা যায়। আর যে শত্রুকে চেনা যায় না, তাকে মোকাবিলা করা যায় না।’
এই বিশেষজ্ঞও মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি করোনা প্রতিরোধী টিকা গ্রহণের কথা বলেছেন। আর উপসর্গ দেখা দিলেই বলেছেন পরীক্ষা করাতে।
তবে করোনার টিকা চাইলেই এখন নেয়া যাচ্ছে না। ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকা কেনার যে চুক্তি হয়েছিল, সেটি দৃশ্যত ভেঙে গেছে। টিকার অভাবে প্রথম ডোজ বন্ধ হয়ে গেছে। এমনটি প্রথম ডোজ যাদের দেয়া হয়েছে, তাদের দ্বিতীয় ডোজ দেয়া যাবে কি না, তা নিয়েও তৈরি হয়েছে শঙ্কা।
কারণ যাদের প্রথম ডোজের টিকা দেয়া হয়েছে, তাদের দ্বিতীয় ডোজ দিতে হলে সিরাম থেকে আরও ১৩ লাখ টিকা আনতে হবে। কিন্তু ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞায় তারা তা পাঠাতে পারছে না।
অধ্যাপক নজরুলের মতোই লেনিন চৌধুরীও মানুষের চলাচল, বিশেষ করে ঈদ কেনাকাটার চিত্র দেখে শঙ্কিত। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে উদ্বেগের কারণ হচ্ছে, ঈদকে কেন্দ্রে করে দেশে বাড়ি ফেরা মানুষ ও মাকের্টগুলোতে উপচে পড়া ভিড়। যে কারণে করোনা বিস্তারে একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি হতে পারে।’