দেশে করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকার মজুত ফুরিয়ে আসছে। যে পরিমাণ টিকা আছে তাতে চাহিদা মেটানো যাবে বড়জোর আর ৯ দিন।
টিকার চূড়ান্ত সংকট তৈরির আগেই সমাধান খোঁজায় জোর তৎপরতা চালাচ্ছে সরকার। ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট ছাড়াও চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে টিকা আনতে কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো হচ্ছে।
আশ্বাসের কথা জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও। তিনি বলেন, শেষ হওয়ার আগেই টিকা আসছে, আগামী ১০ মের মধ্যেই চীন থেকে উপহারের টিকা আসছে।
চীন থেকে শিগগিরই টিকা আসছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন। বুধবার সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ১২ মের মধ্যে চীনের উপহারের ৫ লাখ ডোজ টিকা পৌঁছাতে পারে দেশে।
এই টিকা আসলেও তা দিয়ে চলমান দ্বিতীয় ডোজ টিকার সংকট মিটছে না। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার প্রথম ডোজ নেয়ার পর দ্বিতীয় ডোজে অন্য টিকা নেয়া যাবে কি না সে ব্যাপারেও রয়েছে ধোঁয়াশা।
দেশে গণটিকা চলছে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত কোভিশিল্ড টিকা দিয়ে। নিয়মানুযায়ী, করোনা প্রতিরোধী টিকার দুই ডোজ একই কোম্পানির হতে হবে। বিশ্বজুড়ে সেভাবেই প্রয়োগ চলছে।
করোনারোধী টিকা কার্যক্রমে দেশে এখন পর্যন্ত সিরামের টিকারই প্রয়োগ চলছে। ৩ কোটি ডোজ টিকা আনতে গত বছরের ৫ নভেম্বর ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করে বাংলাদেশ সরকার। চুক্তি অনুষ্ঠানে ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামীও।
চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ করে ধাপে ধাপে ছয় মাসে দেশে ৩ কোটি ডোজ টিকা পৌঁছানোর কথা থাকলেও সিরাম তা পারছে না। প্রতিষ্ঠানটি দুই ধাপে ৭০ লাখ ডোজ টিকা দিতে পেরেছে। বাকি টিকা পাওয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে বড় অনিশ্চয়তা।
সিরাম থেকে ৫০ লাখ ডোজের প্রথম চালানটি আসে গত জানুয়ারিতে। ফেব্রুয়ারিতে দ্বিতীয় চালানে টিকা আসে ২০ লাখ ডোজ। কেনা টিকা ছাড়াও ভারত সরকার তিন ধাপে বাংলাদেশকে উপহার হিসেবে ৩৩ লাখ ডোজ টিকা দিয়েছে। সব মিলিয়ে দেশে টিকার মজুত দাঁড়ায় ১ কোটি ৩ লাখ ডোজ।
এর মধ্যে ভারতে করোনার সংক্রমণ বেড়েছে। দেশটিতে প্রতিদিনই করোনায় শনাক্ত ও মৃত্যুর রেকর্ড হচ্ছে। এতে দেশটিতে টিকার অভ্যন্তরীণ চাহিদা ব্যাপক বেড়েছে। ফলে বাইরের দেশে টিকা দিতে পারছে না সিরাম।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সবশেষ তথ্য বলছে, ৫ মে পর্যন্ত দেশে করোনা প্রতিরোধী টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৫৮ লাখ ১৯ হাজার ৮১১ জন। এদের মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ৩২ লাখ ১০ হাজার ৫০৯ জন।
সব মিলিয়ে ফুরিয়েছে ৯০ লাখ ৩০ হাজার ৩২০ ডোজ টিকা। মজুত আছে ১২ লাখ ৭০ হাজারের কিছু বেশি। যারা প্রথম ডোজ নিয়েছেন তাদের দ্বিতীয় ডোজ পূর্ণ করতে এখনও দরকার ২৬ লাখ ৯ হাজার ডোজের মতো টিকা।
বুধবার দেশে দ্বিতীয় ডোজের টিকা প্রয়োগ হয়েছে ১ লাখ ৩৮ হাজার ডোজ। এই হারে টিকার প্রয়োগ চললে ৯ দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে মজুত।
পেছাচ্ছে দ্বিতীয় ডোজ প্রয়োগ
টিকার দ্বিতীয় ডোজ প্রয়োগ শুরু হয় ৮ এপ্রিল থেকে। শুরুর দিকে প্রায় ২ লাখ টিকা দেয়া হতো। এমন পরিস্থিতি ছিল প্রায় দুই সপ্তাহ। টিকার সংকট দেখা দেয়ায় একপর্যায়ে কমে আসে এক লাখের নিচে।
মঙ্গলবার ৮৩ লাখের মতো মানুষ দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন। এ ছাড়া, অনেকের মোবাইলে এমন এসএমএস আসছে- ‘আপনার দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেয়ার তারিখ ৬ মে ছিল, আপনি ৩ দিন পরে ৯ মে এসে টিকা নিয়ে যাবেন। এতে আপনার সুরক্ষার কোনো সমস্যা হবে না।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকেও জানানো হচ্ছে সঠিক সময় টিকা না পেলে দ্বিতীয় ডোজ দেয়া ৮ সপ্তাহের জায়গায় পিছিয়ে ১২ সপ্তাহ করা হবে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সময়মতো টিকা না পেলে করোনার দ্বিতীয় ডোজ টিকা নিতে আট সপ্তাহের জায়গায় ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
‘আমরা সক্রিয়ভাবে কাজ করছি। যাদের সিরামের প্রথম ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে, তাদের আট সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেয়ার জন্য। তবে যদি কোনো কারণে বিলম্ব হয়, যে টিকা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তা যদি না আসে, তবে আমরা দ্বিতীয় ডোজ নেয়ার জন্য ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলব।’
১২ সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ টিকা না দেয়া গেলেও আশঙ্কার কিছু নেই বলে জানান সেব্রিনা। তার মতে, প্রথম ডোজ টিকা নিলে শরীরে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত সুরক্ষা তৈরি হয়।
চীন-রাশিয়ার টিকা দিয়ে প্রথম ডোজ
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, এ মাসের মধ্যে চীন ও রাশিয়া থেকে টিকা পাওয়া যাবে। তবে সেটা দিয়েই এ মাস থেকে আবার প্রথম ডোজ টিকা প্রয়োগের পরিকল্পনা সরকারের।
ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা সরবরাহ অনিশ্চিত হওয়ায় চীন ও রাশিয়ার টিকা জরুরি প্রয়োগের অনুমোদন দিয়েছে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই দুই দেশের টিকা অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা গ্রহণকারীদের ক্ষেত্রে ‘দ্বিতীয় ডোজ’ হিসেবে প্রয়োগের কোনো সুযোগ নেই। নতুন করে যারা টিকা নিতে আগ্রহী, তাদের ক্ষেত্রে প্রথম ডোজ হিসেবেই প্রয়োগ করা হবে চীন ও রাশিয়ার টিকা।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চীনের উপহারের টিকার ৫ লাখ ডোজ আগামী সোমবারের মধ্যে দেশে পৌঁছাবে। তবে প্রথমেই গণহারে এই টিকা প্রয়োগ করা হবে না। নিরাপত্তার স্বার্থে ওষুধ প্রশাসনের বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশে টিকার কার্যকারিতা যাচাই ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখতে প্রথমে ১ হাজার মানুষের ওপর পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা হবে চীনের টিকা।
একসময় টিকাদান কেন্দ্রগুলোতে দেখা যায় দীর্ঘ লাইন। ছবি: নিউজবাংলা
টিকার প্রথম ডোজের নিবন্ধন স্থগিত
করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকা সংকট দেখা যাওয়ায় টিকা পেতে আগ্রহীদের নতুন নিবন্ধন কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে সরকার।
বুধবার বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা নিউজবাংলাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয় ডোজ টিকা নিতে এখনও ১৪ লাখ টিকা সংকট রয়েছে। দ্বিতীয় ডোজ নিশ্চিতের পর আবার নিবন্ধনের সুযোগ দেয়া হবে।’
টিকা সংকটের কারণে এর আগে গত ২৬ এপ্রিল থেকে প্রথম ডোজ প্রদান স্থগিত করে দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এবার নিবন্ধনই বন্ধ করে দেয়া হলো।
মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে টিকা সংকট নিরসনে কাজ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে চীন ও রাশিয়া থেকে এই মাসের মধ্যে টিকা আসার কথা রয়েছে। তবে এখনও চুক্তি ও তারিখ ঠিক হয়নি। আশা করা যাচ্ছে, এই মাসেই টিকার সংকট নিরসন হবে।
যারা দ্বিতীয় ডোজের জন্য অপেক্ষমাণ তাদের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘যদি কোনো কারণে বিলম্ব হয়, যে টিকা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তা যদি না আসে, তবে আমরা দ্বিতীয় ডোজ নেয়ার জন্য ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলব।’