ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট চুক্তি অনুযায়ী টিকা দিতে না পারার পর বাংলাদেশ রাশিয়া ও চীনমুখী হলেও অক্সফোর্ড উদ্ভাবিত আরও ১৩ লাখের বেশি টিকা লাগবেই বাংলাদেশের।
হাতে ৭০ লাখ টিকা নিয়ে গত ৭ ফেব্রুয়ারি গণটিকা শুরু করে বাংলাদেশ।
এরপর সিরাম পাঠিয়েছে আরও ২০ লাখ আর ভারত সরকার উপহার হিসেবে প্রথমবার ২০ লাখের পাশাপাশি দ্বিতীয়বারের মতো পাঠিয়েছে আরও ১৩ লাখ টিকা। সব মিলিয়ে টিকার সংখ্যা হয় ১ কোটি ৩ লাখ।
অথচ প্রতি মাসে সিরাম থেকে ৫০ লাখ করে সর্বমোট ৩ কোটি ৪০ লাখ আর বিশ্বজুড়ে ন্যায্যতার ভিত্তিতে টিকা বিতরণে আন্তর্জাতিক জোট কোভ্যাক্স থেকেও পাওয়ার কথা ছিল টিকা।
কোভ্যাক্সেরও টিকা নেয়ার কথা ছিল সিরাম থেকেই। কিন্তু ভারতে করোনার ব্যাপক বিস্তার আর যুক্তরাষ্ট্র কাঁচামাল দেয়া বন্ধ করে দেয়ার কারণে উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটনায় সে দেশের সরকার টিকা রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়। এ কারণে বাংলাদেশের জন্য প্রস্তুত ৫০ লাখ টিকা পাঠাতে পারেনি সিরাম।
এই পরিস্থিতিতে টিকার প্রথম ডোজ দেয়া বন্ধ করে সরকার চালু রেখেছে কেবল দ্বিতীয় ডোজ।
গণটিকা শুরুর ৭৮ দিনের মাথায় প্রথম ডোজ বন্ধ হয়ে গেলেও ততদিনে প্রয়োগ করা হয় ৫৮ লাখ ১৯ হাজার ৬৪৬ টিকা। এদের সবার দ্বিতীয় ডোজ লাগবেই।
এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য বলছে, প্রথম ডোজ যে কোম্পানির টিকা দেয়া হয়েছে, দ্বিতীয় ডোজের সেই পরিমাণ টিকাই লাগবে। ফলে প্রথম ডোজে যাদের সিরামের টিকা দেয়া হয়েছে, তাদের সবার টিকা নিশ্চিত করতে হলে আরও অন্তত ১৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৯২ ডোজ টিকা লাগবেই।
গত ২১ জানুয়ারি উপহার হিসেবে ২০ লাখ টিকা পাঠায় ভারত। এরপর বাংলাদেশের কেনা ৭০ লাখ ও উপহারের আরও ১৩ লাখ টিকা আসে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী প্রথম ডোজ নেয়ার দুই মাসের মধ্যে নিতে হবে দ্বিতীয় ডোজ, এতে সুরক্ষা ও প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি মিলবে। কিন্তু ভারত সরকারের নির্দেশে সিরাম আগামী জুন পর্যন্ত টিকা দেয়া বন্ধ রাখছে। ফলে চলতি মাসের মধ্যেই যদি এই ১৩ লাখ ৩৯ লাখ ২৯২টি টিকার সংস্থান নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে যাদের প্রথম ডোজের টিকা দেয়া হয়েছে, তাদের সবার টিকা দেয়া যাবে না।
সিরামের টিকার অনিশ্চয়তার মধ্যে সরকার রাশিয়া উদ্ভাবিত স্পুৎনিক ফাইভ ও চীনের সিনোফার্মের টিকার অনুমোদন দিয়েছে। দুটি টিকা দেশেই উৎপাদিত হবে বলে জানানো হয়েছে।
এর মধ্যে সিরামের টিকা না এলে কী করা হবে, বাকিদের চীনা বা রাশিয়ার টিকার দুই ডোজ আবার দিতে হবে কি না, এ বিষয়ে এখনও কোনো কিছুই নির্ধারণ করতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ হক অবশ্য জানিয়েছেন, মে মাসে সিরাম আরও ২০ লাখ টিকা পাঠাবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আশা করছে মে মাসেই হয়তো আমরা সিরাম থেকে টিকা পাব। সেটা যদি পেয়ে যায় তাহলে দ্বিতীয় ডোজ টিকা নিয়ে আমাদের চিন্তা করতে হচ্ছে না। যদি সিরাম টিকা দিতে দেরি করে তাহলে অন্য কোম্পানি টিকা দিয়ে দ্বিতীয় ডোজ দেয়া যায় কি না এ বিষয়ে করোনা নিয়ন্ত্রণে গঠিত কারিগরি কমিটি একটি মিটিং করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।’
গবেষণা চলছে
ভিন্ন ভিন্ন ভ্যাকসিন দেয়া নিরাপদ এবং কার্যকর কিনা তার উত্তর পেতে গত ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাজ্যে একটি গবেষণা শুরু হয়েছে। ৮০০ ভলান্টিয়ারের উপর অ্যাস্ট্রেজেনকা এবং ফাইজারের ভ্যাকসিন দিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এই গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল পাওয়া যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সিরামের টিকার অনিশ্চয়তার মধ্যে রাশিয়া ও চীনের টিকা অনুমোদন দেয়া হয়েছে, মে মাসেই স্পুৎনিকের ৪০ লাখ টিকা পাওয়ার আশা করছে ঢাকা
কানাডার কুইবেকের স্বাস্থ্য বিভাগ যেসব সিনিয়র সিটিজেনকে এর আগে মর্ডানার ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছিল, তাদের দ্বিতীয় ডোজটি ফাইজারের দেয়ার ব্যাপারে আলোচনা শুরু করেছে। ভিন্ন ভিন্ন ডোজের ভ্যাকসিন নিরাপদ এবং কার্যকর প্রমাণিত হলে টিকার সংকট মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তবে দেশে এ ধরনের কোনো গবেষণা না থাকায় সিরামের টিকা দিয়েই দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার পক্ষে মন দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার প্রথম ডোজ নেয়ার পর সিনোফার্ম বা স্পুৎনিক ফাইভ-এর টিকা দ্বারা দ্বিতীয় ডোজ দেয়া যাবে কি না তা পর্যবেক্ষণের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের মতামতের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্তের নেয়া হবে।’
তবে এই চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন প্রথম ডোজ যে কোম্পানির টিকা দেয়া হয়েছে, দ্বিতীয় ডোজ সেটিই দেয়া ভালো।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখনও পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো যারা অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন তারা দ্বিতীয় ডোজও এই কোম্পানিরই নেবেন। অন্য কোনো টিকা দিয়ে দ্বিতীয় ডোজ দেয়া যাবে কি না সে বিষয়ে আমাদের ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশন টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজারি গ্রুপ আছে, তাদের কাছে বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়েছে। তারা একটি মিটিং করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন।’
ভারত থেকে ৩৩ লাখের পর চীন থেকে পাঁচ লাখ টিকা উপহার পাচ্ছে বাংলাদেশ
তিন টিকায় নতুন পরিকল্পনা ‘লাগবে’
সিরাম যদি প্রতিশ্রুত ৩ কোটি ৪০ লাখ টিকা দেয়, পাশাপাশি যদি চীন ও রাশিয়ার টিকা উৎপাদিত হয়, তাহলে টিকা পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে হবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ফার্মাকোলজি সোসাইটির সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান খসরু।
তিনি বলেন, তখন কে কোন ডোজ নেবেন, সেটি যদি সরকারের হাতে থাকে, তাহলে এক কথা। কিন্তু যদি জনগণের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে, তাহলে বেশ কিছু আগাম পরিকল্পনা করতে হবে।
অধ্যাপক খসরু বলেন, ‘এখন যেহেতু কয়েক ধরনের টিকা দেশে আসার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, তাই ওই টিকার কোনটির কী ধরনের ডোজ-শিডিউল, তা বিবেচনায় রেখে পরিকল্পনা সাজাতে হবে, নীতিমালা ঠিক করতে হবে। এত দিন একটিই টিকা ছিল বলে কারো পছন্দ-অপছন্দের কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু সামনে সুযোগ আসছে তাই কে কোন টিকা পাবে, সেটি কীভাবে ঠিক হবে সেটাও মানুষকে আগেই জানিয়ে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে হবে।’
‘যদি বেশির ভাগ মানুষ কোনো একটি বিশেষ টিকার ওপর বেশি আগ্রহী হয়, তখন ওই টিকার জোগান কীভাবে হবে, সেটাও ভাবনার বিষয় আছে। বিষয়গুলো যদি খুব হালকাভাবে নেয়া হয়, তবে ভুল হবে’-বলেন এই চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ।