বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কোনো যন্ত্রই সচল নেই যে হাসপাতালে

  •    
  • ৩০ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০

রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা সংক্রান্ত জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি প্রায় সবগুলোই এখন অচল। মেরামতের অপেক্ষায় পড়ে আছে মাসের পর মাস। না চলছে ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন। না চলছে ডায়ালাইসিস।

একটা বিভাগের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল। শয্যা সংখ্যা ১ হাজার। কিন্তু এ হাসপাতালে ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন নষ্ট। কাজ করে না সিটি স্ক্যান, ইকোকার্ডিওগ্রাম, ডায়ালাইসিস, এমআরআই, এন্ডোসকপি মেশিন। সবই বিকল।

রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব চিকিৎসা যন্ত্র মাসের পর মাস অকেজো হয়ে পড়ে আছে। কোনো কোনোটি বছরের পর বছর ধরে অচল। মেরামতের উদ্যোগ নেই।

সরকারি হাসপাতালগুলো যন্ত্রপাতি মেরামতের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি আলাদা সংস্থা আছে, যেটির নাম ন্যাশনাল ইলেকট্রো-মেডিক্যাল ইক্যুইপম্যান্ট মেইনটেন্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার (নিমিউ অ্যান্ড টিসি)। এটির প্রধান টেকনিক্যাল ম্যানেজারের কাছে চলতি মাসে দুই দফা চিঠি দিয়েও কোনো উত্তর পাচ্ছে না রংপুরের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

এ হাসপাতালের রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের ইনচার্জ হারুন-উল-কবির জানান, হাসপাতালে দুটি ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন স্থাপন হয় ২০১৪ সালে। এখন দুটিই অচল। একটি বিকল হয়েছে ২০২০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। অপরটি একই বছরের ১০ অক্টোবর। আরও পাঁচটি সাধারণ এক্স-রে মেশিন বিকল দীর্ঘদিন ধরে।

হাসপাতালের সিঙ্গেল স্লাইস সিটি স্ক্যান মেশিন স্থাপন করা হয় ২০০৬ সালের ৯ জুলাই। এটি বিকল হয়ে পড়ে আছে ২০১৯ সালের ৩০ আগস্ট থেকে। অন্যদিকে, ৬৪ স্লাইস সিটি স্ক্যান মেশিন স্থাপন করা হয় ২০১২ সালের ২৮ মার্চ। এটিও বিকল হয়ে পড়ে আছে ২০১৯ সালের ১৯ মার্চ থেকে।

হাসপাতালের এমআরআই মেশিনও ২০১৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে অকেজো। আরেকটি এমআরআই মেশিন বিকল হয় ২০১৮ সালের ৬ অক্টোবর।

এই ইউনিটে ২০১৯ সালে আরও একটি অত্যাধুনিক এমআরআই মেশিন স্থাপন করা হয়। ফিল্ম হলেই এটি চালু করা সম্ভব। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সেটি চালু হচ্ছে না।

হাসপাতালের হৃদরোগ ইউনিটে গুরুত্বপুর্ণ পাঁচটি ইকোকার্ডিওগ্রাম মেশিনে ধুলা পড়ছে বহুদিন ধরে।

হৃদরোগ ইউনিটের সিসিইউ ওয়ার্ডের ইনচার্জ রহিমা বেগম জানান, ইউনিটের সর্বাধুনিক ১০ বেডের ইউনিট তার। ওয়ার্ডের দুটি আধুনিক ইকো মেশিনের দুটিই বিকল হয়ে পড়ে আছে। ২০১৭ সালের ২৪ জানুয়ারি এগুলো চালু করা হয়েছিল। বছর না ঘুরতে সেগুলো অচল।

এ ইউনিটের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের (পুরাতন সিসিইউ) ইনচার্জ কহিনুর বেগম জানান, তার ওয়ার্ডে তিনটি ইকো কার্ডিওগ্রাম কালাম মেশিন বিকল হয়ে পড়ে আছে। একটি মেশিন এমনকি ২০১০ সাল থেকে বিকল। তার ওয়ার্ডে এখন একটিও ইকোকার্ডিওগ্রাম কালাম মেশিন সচল নেই।

হাসপাতালের ডায়ালাইসিস ইউনিটের টেকনিশিয়ান মাসুদ জানান, কিডনি রোগিদের জন্য এই ওয়ার্ডে ২৫টি ডায়ালাইসিস মেশিনের মধ্যে ১২টি বিকল। দুটি বায়োপ্লান্টের উভয়ই নষ্ট হওয়ায় চলতি মাসের ৮ এপ্রিল থেকে ডায়ালাইসিস ইউনিট পুরোপুরি বন্ধ।

তিনি জানান, ডায়ালাইসিসের প্রধান উপাদান পিউরিফায়েড পানি, যা মেশিনের সাহায্যে পরিশোধন করা হয়। সেই মেশিন দুটি পুরোপুরি বিকল। এর আগেও কয়েকবার মেশিন দুটি বিকল হয়েছিল, তখন মেরামত করা হয়। এবার ঢাকা থেকে আসা টেকনিশিয়ানরা জানিয়ে দিয়েছেন, এই মেশিন আর সচল করা সম্ভব নয়। নতুন মেশিন স্থাপন করতে হবে।

মাসুদ আরও জানান, একজন কিডনি রোগীকে চার ঘণ্টা ডায়ালাইসিস করতে হয়। এ জন্য একেক রোগীর জন্য ১৮০ লিটার পিউরিফায়েড পানির প্রয়োজন হয়। এটা ছাড়া ডায়ালাইসিস করা যাবে না।

প্যাথোলজিক্যাল ইউনিটের প্রধান ওমর ফারুক জানান, তার ইউনিটে এখন ব্লাড গ্রুপ, ইউরিন আর কোভিড-১৯ ছাড়া কোনো পরীক্ষাই হচ্ছে না। অনেক যন্ত্রপাতি নষ্ট থাকায় গুরুত্বপূর্ণ ৯টি প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা করা কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। এ জন্য বাইরে নোটিশ টানিয়ে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে।

একইভাবে হাসপাতালের এন্ডোসকপি ও কোলোনোসকপি মেশিন দুটিও দীর্ঘদিন ধরে বিকল হয়ে পড়ে আছে।

কেন নষ্ট হয় যন্ত্র?

হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ও ইউনিটের দায়িত্বরত ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, গুরুত্বপূর্ণ এসব যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে মূলত এসির ব্যবহার ঠিকমত না হওয়ায়। মেশিন চালু থাক বা না থাক, এসি চালু রাখতে হয় ২৪ ঘণ্টা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসিই নষ্ট অথবা নাই। ফলে যেসব মেশিন এখনও চালু আছে, সেগুলোও নষ্টের পথে।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, ডিজিটাল এক্স-রে মেশিনে প্রতিদিন কমপক্ষে ৬০ থেকে ৭০টি রিপোর্ট দেয়া হতো। সেটি বন্ধ। সিটি স্ক্যান করা হতো ৫৫ থেকে ৬০ জনের, এমআরআই করা হতো ১৫ থেকে ২০টা। ইকো, ইসিজিও করা হতো প্রয়োজন মতো। রোগীদের এসব পরীক্ষা বাইরে থেকে করিয়ে আনতে হচ্ছে। তাদের খরচ বেড়ে গেছে। আবার হাসপাতালের আয়ও এতে কমে গেছে।

রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করতে ছয় মাসের প্যাকেজে মাত্র ২০ হাজার টাকা লাগে। প্রতিবার ডায়ালাইসিস করতে খরচ পড়ে ৪শ টাকা। এটি বাইরে করালে লাগে প্রতিবার তিন হাজার টাকা। তাই দরিদ্র মানুষরা বাইরে ডায়ালাইসিস করাতে পারেন না।

রোগী ছেড়ে যাচ্ছে হাসপাতাল

হাসপাতালের পরিচালকের দপ্তর জানিয়েছে, ১০০০ শয্যার এই হাসপাতালে বছরের যে কোনো সময় রোগী থাকত দুই থেকে আড়াই হাজার। কখনও বেড সংকুলন হতো না। ফ্লোরে গাদাগাদি করে চিকিৎসা নিত লোকে। এখন সেখানে বৃহস্পতিবার (২৯ এপ্রিল) বিকেল পর্যন্ত ৪৯টি ওয়ার্ডে রোগী মাত্র ৮১৭ জন। এদের মধ্যেও হাসপাতাল থেকে স্বেচ্ছায় চলে গেছেন ৩৪ জন আর না জানিয়ে চলে গেছেন ৩০ জন।

হাসপাতালের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে অনেক রোগী ও তাদের স্বজন হাসপাতাল ছেড়েছেন।

গত তিন দিন হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ কোনো পরীক্ষা হাসপাতাল থেকে করানো যাচ্ছে না। এ কারণে হাসপাতালে বেড ফাঁকা হয়ে পড়ে আছে। কোনো কোনো ওয়ার্ডে একটিও রোগী নেই।

কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার বদিজামালপুর গ্রামের জরিনা বেগম জানান, ‘আমি সার্জারি ওয়ার্ডে চারদিন হইচি ভর্তি হবার। খালি নার্স আইসে, ডাক্তার আইসে না। ঠিক মতন খোঁজ খবর নেয় না।’

রংপুরের বদরগঞ্জের নাগেরহাট থেকে আসা চন্দন সাহা জানান, ‘১৬ নম্বর ওয়ার্ডে আমার দিদি নীলি রানীকে ভর্তি করিয়েছি। বায়োপসি, সিটি স্ক্যান, প্যাথোলজিক্যাল সব টেস্ট বাইরে করিয়েছি। আর হাসপাতালে শুধু করোনার পরীক্ষা করা হয়েছে। টেষ্ট করতে এত খরচ, মনে হচ্ছে দিদির চিকিৎসা করা সম্ভব হবে না।’

পঞ্চগড় থেকে আসা বাবুল হক জানান, ‘আমি আমার বাবা শহিদুল ইসলামকে ৬ নং ওয়ার্ডে ভর্তি করিয়েছি। চিকিৎসকরা প্রথমে যে টেস্ট দিয়েছে, তাতে ৫ হাজার টাকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। আরও যেসব পরীক্ষা দিয়েছে, তাতেও ৫ হাজারের বেশি টাকা লাগবে। আমাদের মত যারা সাধারণ মানুষ আছে, তাদের জন্য এখানে বিন্দুমাত্র সুযোগ-সুবিধা নেই। যত টেস্ট দিচ্ছে সবগুলো বাইরে করতে হচ্ছে। আমাদের পক্ষে খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে।’

যন্ত্রপাতিগুলোর দেখভাল করা ইউনিটের প্রধানরা জানিয়েছেন, তারা প্রতি মাসেই হাসপাতালের পরিচালকের বরাবর আবেদন করছেন মেশিনগুলো সচল করতে। কিন্তু হচ্ছে না।

রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক রেজাউল করিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২০১৯ সালে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত পরিচালক রোস্তম আলী নিমিউ অ্যান্ড টিসির প্রধানকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন। আমি এসেও চলতি মাসে দুই দুইবার চিঠি দিয়েছি। তাদের সঙ্গে কথাও বলেছি। তারা দ্রুত আসবে বলেও জানিয়েছেন। এই মুহূর্তে দরিদ্র মানুষগুলোকে আমরা সাপোর্ট দিতে পারছি না। তবে দ্রুব শিগরিই এর ব্যবস্থা হবে।’

রোগীরা চিকিৎসা না পাবার বিষয়ে পরিচালক বলেন, করোনার কারণে ইন্টার্ন ডাক্তাররা সিডিউল অনুযায়ী ভিজিট করছেন আর সিনিয়ারা তো আসছেনই। কিন্তু কেন এমন অভিযোগ তা খতিয়ে দেখা হবে।

এ নিয়ে হাসপাতাল পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ও রংপুর-৩ আসনের সংসদ সদদ্য সাদ এরশাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।

এ বিভাগের আরো খবর